ঢাকা: পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (পলিটিক্যাল শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলায় নিহতদের একমাত্র মেয়ে ঐশী রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার অন্য আসামি ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে খুনের ঘটনার পর ঐশীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে দু’বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে তাকে আরও একমাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। অপর আসামি ঐশীর বন্ধু আসাদুজ্জামান জনি খালাস পেয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ। ঐশীকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দু’টি খুনের জন্য পৃথক দু’টি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। দু’টি অপরাধের জন্য আলাদা আলাদা করে ঐশীকে দুইবার ফাঁসি ও দু’বারে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। হাইকোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আসামি ইচ্ছা করলে বিচারিক ট্রাইব্যুনালের রায় চ্যালেঞ্জ করে ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করতে পারবেন বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারাগারে থাকা দুই আসামি ঐশী রহমান ও আসাদুজ্জামান জনিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা মিজানুর রহমান রনি আদালতে হাজির ছিলেন। সাজা পরোয়ানা দিয়ে ঐশী ও রনিকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে আসার পর থেকেই বিষন্ন ছিলেন ঐশী। কারও সঙ্গে তেমন কোন কথা বার্তা বলেননি। ডান হাতে তসবিহ আর বাম হাতে ইনহেলার ছিল ঐশীর। রায় ঘোষণার পর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সারাদেশ যেখানে শিশু নির্যাতনের বিপক্ষে সোচ্চার সেখানে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একজন শিশুর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন ছিল।
আসামিপক্ষ থেকে ঐশীকে শিশু, ঘটনার সময় ঐশী মাতাল ছিল আর হত্যাকাণ্ড ছিল নিছক একটি দুর্ঘটনা এমন দাবি বিচারক নাকচ করে দেন বিচারক। তিনি বলেন, আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, ঐশীর বয়স ১৮ বছরের বেশী। ঘটনার সময় তিনি শিশু ছিলেন না। আর হত্যাকাণ্ডটি নিছক দুর্ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। খুনের আগে সময় নিয়েই ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেন ঐশী।
বিচারক তার রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, ঐশীর খুন করার ইচ্ছা ছিল মূলত তার মাকে। কিন্তু শুধু মাকে খুন করে তো বাঁচতে পারবেন না মনে করে তার বাবাকেও খুন করেন তিনি। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
ঐশীর আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা জানান, তারা এ রায়ে সন্তুষ্ট নন। হাইকোর্টে তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (পলিটিক্যাল শাখা) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর পরদিন ঐশী গৃহকর্মী সুমীকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন। পরে গ্রেফতার করা হয় অন্য দুই আসামি রনি ও জনিকে। তাদের মধ্যে আসামি রনিকে গত ৩১ মার্চ জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন ঐশী। পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল দাবি করে ৫ সেপ্টেম্বর স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। আদালত তা নথিভূক্ত রাখার নির্দেশ দেন।
গত বছরের ৯ মার্চ ডিবির ইন্সপেক্টর আবুয়াল খায়ের মাতুব্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে ঐশীসহ ৪ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দু’টি চার্জশিট দাখিল করেন।
অপর আসামি গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার মামলাটির বিচার চলছে শিশু আদালতে। গত বছরের ২০ মে সুমির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে সুমিকে জামিন দেন শিশু আদালতের বিচারক জাকিয়া পারভিন। গত বছরের ১ জুন গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্র থেকে মা সালমা বেগমের জিম্মায় জামিনে মুক্তি পেয়েছে সে।
গত বছরের ৬ মে ঐশীসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন মহানগর দায়রা জজ আদালত।
ঐশীদের মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলে গত বছরের ৩০ নভেম্বর নতুন করে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
এ মামলায় ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে বাদী ঐশীর চাচা মো. মশিহুর রহমান রুবেলসহ ৩৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে।
গত ১৩ অক্টোবর মামলাটির প্রধান আসামি ঐশীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন আদালত। আত্মপক্ষ সমর্থনকালে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তার বক্তব্য লিখিতভাবে আদালতে দাখিল করেন ঐশী। অন্য দুই আসামি জনি ও রনিও নিজেদের নিদোর্ষ বলে দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।
বয়সের সমর্থনে একটি সনদপত্র আদালতে দাখিল করে ঐশী দাবি করেন, ঘটনার সময় তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। পুলিশ নির্যাতন করে তার স্বীকারোক্তি আদায় করে। তার বাবা-মা যখন খুন হন তখন তিনি বাসায় ছিলেন না। বন্ধুর বাসায় হুইস্কি খেয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন। তার বাবা-মাকে কে বা কারা খুন করেন তাও তিনি জানেন না।
গত ২০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর পক্ষে বিপক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন উভয়পক্ষের আইনজীবীরা। রাষ্ট্রপক্ষে স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান ও আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ ও মাহবুবুর রহমান রানা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
গত ৪ নভেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ রায়ের এ দিন ধার্য করেন।
মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার প্রায় ১ বছর পর বৃহস্পতিবার এ রায় ঘোষণা করা হলো।