পারলেন না মেসি, চ্যাম্পিয়ন চিলি

SHARE

chili cম্যাচ দেখার আলাদা একটা মজা আছে। এই ম্যাচে ‘ফেভারিট’ বলে কেউ হয় না। হয়তো একটা দল একটু বেশি শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু সেই দিনে যে ভাল খেলবে সেই করবে বাজিমাত।ৎ

সান্তিয়াগোর গ্যালারিতে তখন শুধু চোখে পড়ছে চিলির পতাকা। প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো দর্শক খেলা শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে এসেই হাজির। দলের ফাইনালে ওঠার এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যারা উপভোগ করতে মরিয়া। শেষমেশ কি এই খুশির আমেজে বিষাদের চিরস্রোত বয়ে যাবে? এক একটা গ্যালারিতে প্রায় হাজারখানেক চিলি সর্মথকদের মধ্যে আবার লুকিয়ে ছিল আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। যাদের মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল কতটা অসহায়। কিন্তু মুখে যাই দেখাক মনে মনে হয়তো ভাবছিল, ‘নব্বই মিনিট শেষ হতে দে। তার পর আমরা চেঁচিয়ে বলব ক্যাম্পিওনেস ক্যাম্পিওনেস। আমাদের মেসি বলে একটা ফুটবলার আছে।’ সব মিলিয়ে আর্জেন্টিনাও তৈরি ছিল ট্রফি খরা কাটাতে। তবে তারা কি ঘরের সর্মথকদের সেলিব্রেশন নষ্ট করতে সফল হবে? এই দুটো কোটি টাকার প্রশ্ন তখন আমার মাথায় ঘুরছে। ভাবলাম এমন একটা ম্যাচ দেখব যেখানে হয়তো আবেগের অভাব থাকবে না। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই থাকবে। তবেই না সেটা যোগ্য ফাইনাল হবে। কিন্তু নব্বই মিনিট শেষে এমন একটা ম্যাচ দেখা হলো যা কোনো দাবা খেলার থেকে কম ছিল না। সামপাওলি ও মার্টিনো, দুই কোচই ভালো ভাবে ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন। কেউ বেশি ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। ওপেন খেলার মধ্যেও তাই সতর্ক ফুটবলটাই খেলল দুই দল।

লিওনেল মেসি যতই ক্লাব ফুটবলে দুর্দান্ত খেলুক। যতই নতুন রেকর্ড করুক। দেশের হয়ে যতক্ষণ না ট্রফি জিতছেন তার শ্রেষ্ঠত্বে একটু হলেও দাগ লেগেই থাকবে। সমালোচকরা তো সু্যোগ খোঁজেন, কখন মেসি নামবেন আর্জেন্টিনার হয়ে আরা তারা বলে দেবেন, ‘মেসি তো দেশের হয়ে খেলতেই পারে না।’ সেই কথা বলার আগে যাতে সবাই একশোবার ভাবে সেই লড়াইটা তো ছিল মেসির। গোটা কোপায় যেই জয়ের জেদ দেখা গিয়েছে মেসির মধ্যে এদিনও সেটাই দেখা গেল। রোমিং ফরোয়ার্ডে শুরু করে মাঝ মাঠ থেকেই প্লে-মেকার হিসাবে খেলছিলেন এলএম টেন। শুরুর থেকেই থ্রু পাস, ড্রিবল সব কিছুই করতে থাকেন। দি’মারিয়ার সঙ্গে কম্বাইন করার চেষ্টা। লং বল বাড়িয়ে বিপক্ষ ডিফেন্সের হাই লাইনের সু্যোগ নেওয়া। ড্রিবল করে প্রতি আক্রমণ তৈরি করা। ডিফেন্ডারদের ফাইনাল ট্যাকলে বাধ্য করা। ব্যস ওইটুকুই। ফের ফাইনালে ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে মেসি-ম্যাজিক। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে যেমন হয়েছিল এ দিনও যত ম্যাচ এগোয় মেসি হারিয়ে যায়। বল দখল পেতে ব্যর্থ হন। সেই ‘সোলো-রান’ নিতে পারেন না। ডিফেন্ডাররা জমাট বেঁধে দেওয়ায় খুব বেশি জায়গাও পাননি। গোটা ম্যাচে তার স্মরণীয় মুহূর্ত বলতে নব্বই মিনিটের শেষের দিকে গতি নিয়ে চিলি মাঝ মাঠ ফালাফালা করে উঠে লাভেজ্জিকে পাস দেওয়া। আর লাভেজ্জির পাস থেকে প্রায় গোল করে দিচ্ছিলেন ইগুয়াইন। যদি না বলটা গিয়ে লাগত নেটের ধারে।

মেসি ছাড়াও আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ড লাইনে যা রসদ আছে তা দেখলে মনে হবে কোনো কোচের চিন্তাই থাকবে না এ রকম সমস্ত ফুটবলারকে একসঙ্গে পেলে। কে নেই? প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন বুট জয়ী সের্জিও আগেরো থেকে সেরি এ দাপানো ইগুয়াইন, তেভেজ। আবার দি’মারিয়ার মতো ইঞ্জিন। পাস্তোরের মতো বল প্লেয়ার। আর কী চাই? তবে এই সমস্ত তারকারা ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বমানের হলেও দল হিসাবে কোনো যোগসূত্র তৈরি করতে পারে কোথায়? অসংখ্য পাস খেলেও ফাইনাল থার্ডে গিয়ে ব্যর্থ। দশটা সু্যোগ তৈরি করেও আটটা নষ্ট। প্রতিটা ফরোয়ার্ডের পারফরম্যান্স যদি দেখা হয় ছবিটা ঠিক এ রকম দাঁড়াবে।

আগেরো- নড়াচড়া করলেন। ভাল জায়গায় গেলেন। কিন্তু মেসির ফ্রি-কিক থেকে একটা হেড ছাড়া কোনো উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত নেই।

পাস্তোরে- শ্যাডো স্ট্রাইকারে খেলা মানে স্ট্রাইকারকে পাস বাড়িয়ে যাওয়া। সেটা করলেন কোথায়?

দি’মারিয়া- ভালো শুরু করলেও সেই চোটের জন্য তাড়াতাড়ি উঠে যেতে হলো।

পরিবর্তে নামা ইগুয়াইন ওই একটা নেটের ধারে মারা ছাড়া কিছুই করেননি। লাভেজ্জিও ভালো সু্যোগ পেয়ে নষ্ট করলেন।

প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা হয়ে উঠেছিল ২০১৪ বিশ্বকাপের জার্মানি। গোলের সামনে দক্ষ। মনোরঞ্জক খেলা। আবার চিলির বিরুদ্ধে হয়ে উঠল ২০১০ বিশ্বকাপের স্পেন। ধুকতে ধুকতে স্লো খেলা। তবে স্পেন অন্তত ফাইনালে একস্ট্রা টাইমে গিয়ে গোল পেয়েছিল। এই আর্জেন্টিনা সেটাও পারল না।

ফাইনালের দু’তিন দিন আগের থেকেই সবাই আর্জেন্টিনাকে অঘোষিত চ্যাম্পিয়ন বলেই দিয়েছিল। প্রতিটা বিশেষজ্ঞের মত ছিল, ‘এক প্রকার হাঁটতে হাঁটতেই কোপা চ্যাম্পিয়ন হবে আর্জেন্টিনা।’ কিন্তু সেটা হলো কোথায়! নিজেদের ঘরের মাঠে চিলিই তো সাহসী ফুটবলটা খেললো। বিপক্ষে মেসি থাকলেও কী? চিলি ভয় পেল না আক্রমণ করতে। প্রথমার্ধে ভারগাসের দুটো শট ছাড়াও বিরতির পরে তো শুধুই চিলি।  ভিদালের দুটো শট টার্গেটে থাকলেও গোল হল না। আর আর্জেন্টিনা ডিফেন্স তো বর্তমানে দলের দুর্বল অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ভারগাস-সাঞ্চেজের গতি সামলাতে গিয়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হয়ে দাড়িয়েছিল ওটামেন্ডি-ডেমিশেলিসের। চিলির সাঞ্চেজের ভলি যদি একটুর জন্য সেকেন্ড পোস্ট ঘেষে না বেরোতো, ৯৯ বছরের অভিশাপ ওখানেই শেষ হত চিলির জন্য। দরকার পড়ত না একস্ট্রা টাইমের। অবশ্য একস্ট্রা টাইমের ছবিটাও একই রকম ছিল। অবাকই লাগে এত আক্রমণাত্মক প্রতিভা থাকতে গোল কেন হল না।

টাইব্রেকারে গিয়ে আবার এভার বানেগা আর ইগুয়াইনের শট দেখে মনে হলো ওরা আর্জেন্টিনা বনাম কলম্বিয়ার ভিডিও দেখেছিল। আর সেখানেই শেষ সব। মেসির দেশের হয়ে ট্রফি জেতার স্বপ্ন। আর্জেন্টিনার ২২ বছরের ট্রফি খরা কাটানোর স্বপ্ন।

সাঞ্চেজের পেনাল্টি কিক যখন জালে গিয়ে জড়ালো তখন গোটা সান্তিয়াগো এক হয়ে চেচিয়ে যাচ্ছে, ‘‘আমরা চ্যাম্পিয়ন।’’ এই আবেগটাই তো কোপা স্বপ্ন পূরণ করল চিলির। শেষ করল ৯৯ বছরের কোপা জেতার অভিশাপ। সবশেষে সান্তিয়াগোর গ্যালারিতে সেই লুকিয়েই থাকতে হলো আর্জেন্টিনা সমর্থকদের।