বিটিআরসির অনিয়ম অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে তোড়জোড়

SHARE

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে বিগত সরকারের বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র। সরকারি নিরীক্ষা, মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদন্ত কমিটি দ্বারা এসব অনিয়ম প্রমাণিত হলেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। শ্বেতপত্রে অভিযুক্তদের নাম উঠে এলে সেই আলোকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ব্যবস্থা গ্রহণের তাগাদা দেন; কিন্তু তা উপেক্ষা করা হচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে হালনাগাদ তথ্য জানানোর কথা থাকলেও তা অবজ্ঞা করে বরং অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার তোড়জোড় চলছে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির মাধ্যমে।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২ ডিসেম্বর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান শেষে সংশ্লিষ্ট টাস্কফোর্স একটি শ্বেতপত্র আকারে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই শ্বেতপত্রে বিটিআরসির নিয়োগ, পদোন্নতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের তালিকায় অন্তত ৩৮ কর্মকর্তার নাম উঠে আসে। তাদের মধ্যে ১১ জন এরই মধ্যে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। বাকি ২৭ জনের মধ্যে একজন পরিচালক অবসর নিয়েছেন, একজন নারী কর্মকর্তা ইস্তফা দিয়েছেন, একজন বিদেশে পালিয়েছেন এবং আরেকজন শিক্ষা ছুটিতে বিদেশে অবস্থান করছেন। একজন গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত হয়ে পদাবনতি পেয়েছেন। অন্য কর্মকর্তারা বিভাগীয় পদোন্নতির জন্য ‘যোগ্য’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন এবং তারা আগামী ৩ জানুয়ারি মেধা যাচাই পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছেন। সূত্র মতে, এ নামমাত্র পরীক্ষার পর তাদের প্রায় সবাই পদোন্নতি পেতে পারেন।

শ্বেতপত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের একান্ত সচিব মোহাম্মদ নাহিদুল করিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘শ্বেতপত্রে দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। কমিশনের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে শ্বেতপত্রের সুপারিশ অনুসারে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তা ২১ ডিসেম্বরের মধ্যে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হলো।’

তবে নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলেও বিটিআরসি কোনো অগ্রগতি জানায়নি। বরং কমিশন অভিযুক্তদের পদোন্নতির প্রস্তুতি জোরদার করেছে। ৯ম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব পদে যাদের চাকরি প্রবিধিমালা অনুযায়ী পদোন্নতির যোগ্যতা হয়েছে, তাদের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, অভিযুক্তরাও এতে অংশ নিচ্ছেন।

‘যোগ্য’ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন আফতাব মো. রাশেদুল ওয়াদুদ, এম এ তালেব হোসেন, খালেদ ফয়সাল রহমান, মো. নাহিদুল হাসান, শারমিন সুলতানা, মাহমুদুর রহমান, মো. মিরাজুল ইসলাম, এস এম তাইফুর রহমান, রাইসুল ইসলাম, সঞ্জীব কুমার সিংহে, তৌহিদুন নাহার, নাফিসা মল্লিক, মেহেরিন আহসান, এস এম গোলাম সারোয়ার, মো. মেহফুজ বিন খালেদ, শামসুজ্জোহা, কাউছার আহমদ, শামসুল আলম, দেলোয়ার হোসেন, আলী কাউছার সুমন, রেজাউল করিম ও রাশেদুল ইসলাম।

তালিকাভুক্ত সাবেক ১১ কর্মকর্তা হচ্ছেন মো. মশিউর রহমান, রহমান খান, তাসমিয়া তাহমিদা, তৌহিদ হোসেন, খান মুহাম্মদ ফুয়াদ বিন এনায়েত, কাজী আফরোজ সুলতানা, ফারিয়া আহসান, কাজী মাহমুদুর রহমান, কাজী রাফসান ইয়াজদানী, শারমিন কিবরিয়া ও আফসার আহমেদ খান চৌধুরী। অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক হলেন গোলাম রাজ্জাক। উপপরিচালক রোখসানা মেহজাবিন চাকরি ছেড়েছেন। উপপরিচালক আসাদুজ্জামান পালিয়ে গেছেন, সামিয়া তাবাসসুম শিক্ষা ছুটিতে বিদেশে আছেন।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিচালিত নিরীক্ষা ২০২০ সালে প্রকাশিত হলে নিয়োগে অনিয়ম ধরা পড়ে। ২০২১ সালে প্রথম তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং অনিয়মের প্রমাণ মেলে। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে আরও দুটি কমিটি গঠন করা হয়, যার প্রতিবেদন ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এসবের পরও বিটিআরসি ব্যবস্থা নেয়নি।

২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশন বিটিআরসিতে অভিযান চালিয়ে নিয়মবহির্ভূত নিয়োগের প্রমাণ পায়। জুনিয়র পরামর্শকদের রাজস্ব খাতে, বয়স শিথিলতার অপব্যবহার এবং প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে অনিয়মতান্ত্রিক নিয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এরপর ৩০ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বিটিআরসিকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিলেও সেটিও উপেক্ষিত হয়।

ফলে, ১০ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নয়টি নির্দেশনা দেওয়া হয়, যার ৭ নম্বরে বলা হয়—যাদের বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত, তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ বিষয়ে বিভাগীয় সচিব আব্দুন নাসের খান কালবেলাকে বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতির সুযোগ নেই। বিটিআরসি এখনো বিস্তারিত কিছু জানায়নি। বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবেন, ফলে অনিয়মের সুযোগ নেই। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছি।’