লন্ডন বৈঠকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথযাত্রা

SHARE

১৩ জুন লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বহুলপ্রতীক্ষিত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরেই এ বৈঠকটি ছিল আলোচনা এবং আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। অবশেষে সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অত্যন্ত সৌহার্দমূলক পরিবেশে তাঁদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী উভয় পক্ষের যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আপাতত বোঝা যাচ্ছে যে বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়েছে।
গণ অভ্যুত্থানের ১০ মাস অতিবাহিত হলেও নির্বাচন কবে হতে পারে তা নিয়ে ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এর মাঝে ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করলেন ২০২৬-এর এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রসঙ্গত, তিনটি রাজনৈতিক দল ছাড়া সব দল এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়ে আসছিল। প্রধান উপদেষ্টার ওই ভাষণের পর নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়।
তার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এ বৈঠক এবং তার ফল গণতন্ত্রের প্রশ্নে জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশে তারেক রহমান ঘোষণা করেছিলেন ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। সবার আগে বাংলাদেশ হৃদয়ে ধারণ করে তারেক রহমান বরাবরের মতোই প্রমাণ করেছেন তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির নিষ্পেষণের শিকার তারেক রহমান সময়ের প্রয়োজনে দায়িত্বশীল ছাড় দিয়ে দেখিয়েছেন, গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পথযাত্রায় তিনি শুধু সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতা নন, আলোচনার টেবিলে এবং রাজনীতির ক্রান্তিলগ্নে ইতিবাচক ভূমিকা পালনেও দক্ষ ও দূরদর্শী।
সুদীর্ঘ সময় ফ্যাসিবাদী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার তারেক রহমান মা খালেদা জিয়ার ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে যথার্থতা প্রমাণ করলেন যে গণতন্ত্রের প্রশ্নের তিনি সত্যিই আপসহীন। তিনি কেবল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নন, বরং একজন সংগ্রামী রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অদম্য প্রতীক। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথমার্ধে তৃণমূলে যে অমূল্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, দ্বিতীয়ার্ধে সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রাণপুরুষে পরিণত করেছে। সংগ্রামী রাজনৈতিক পথযাত্রা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর থেকেই দেশি ও আন্তর্জাতিক একটি মহল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত চরিত্রহননের রাজনীতি শুরু করে যার ধারাবাহিকতা ধরে রাখে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আদর্শ নির্মূল এবং বিদেশি প্রভুভক্ত সুবিধাভোগী রাজনীতি টিকিয়ে রাখার জন্যই আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র ও সহিংসতার সঙ্গে তারেক রহমানকে জড়িত দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালায় ১৬ বছর ধরে এবং রাজনৈতিকভাবে দমনের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। চক্রান্তকারীদের সব প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে তারেক রহমান জাতির ক্রান্তিলগ্নে এসে আরও একবার প্রমাণ করলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমের চেতনাই তাঁর শিরস্ত্রাণ। লন্ডন বৈঠকে দেশকে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে আশার আলো জ্বালিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ ৩৭ বছরের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়কের কাছে বাংলাদেশের মানুষ এমনটাই প্রত্যাশা করে। প্রধান উপদেষ্টাকে No One Is Too Small to Make a Difference এবং Nature Matters : Vital Poems from the Global Majority নামে দুটি বই ও একটি কলম উপহার দিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সৌজন্য ও জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তার নতুন ধারার সূচনা করেছেন।

সমসাময়িক রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ এ বৈঠকে আগামী রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে যে ফলপ্রসূ ঐকমত্য হয়েছে, তা অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশের মানুষের জন্য এনেছে স্বস্তির বার্তা, রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে চাঞ্চল্য। এপ্রিলের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত সময় থেকে সরে এসে নির্বাচনের জন্য একটি যৌক্তিক সময়সীমা নির্ধারণে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে সাধুবাদ জানাই। সব গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা উপলব্ধি করে যে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন তা সত্যিই আমাদের গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের রাস্তা সুগম হলো এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ের ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল।

বৈঠকের আগের ঘটনাপ্রবাহে বোঝা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেই বৈঠকের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকের পর উভয় পক্ষ আলোচনার ফলাফলে যে ‘সন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছে, তা সবার জন্যই স্বস্তিদায়ক। তবে কোনো কোনো রাজনীতি বিশ্লেষক এ স্বস্তি কতদূর স্থায়ী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। বৈঠকের পটভূমির দিকে তাকালে বিষয়টি যৌক্তিক মনে হতে পারে। কারণ এ সংকটের যে গভীরতা সেটা উভয় পক্ষের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল তা থেকে সৃষ্ট। সাধারণভাবে জনমনে যে ধারণা তৈরি হচ্ছিল তা হলো, বিএনপির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা বা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থকদের একাংশ সংস্কার এবং শেখ হাসিনার বিচারের আগে নির্বাচন নয় এবং ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে পাঁচ থেকে ১০ বছর সুযোগ দেওয়ার পক্ষে যে ব্যাপক প্রচার শুরু করে, তা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অবিশ্বাস তৈরির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ বৈঠক শেষে আপাতদৃষ্টে সব অবিশ্বাস দূরীভূত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। সরকার আশাবাদী যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ২০২৬ সালের পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে নির্বাচন আয়োজন করা যায়। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। রমজান যেহেতু মধ্য ফেব্রুয়ারির পরপরই শুরু, সেহেতু নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো আপত্তি নেই। এর অর্থ দাঁড়ায় নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে কিছু সাফল্য প্রধান উপদেষ্টার অন্যতম লক্ষ্য। গণ অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সাফল্য অর্জন করতে চাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন নোবেলজয়ীর জন্য খুবই স্বাভাবিক। বিপরীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও যে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং বিচারের জন্য সময়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছেন, তা বাস্তবতার মাপকাঠিতে অত্যন্ত যৌক্তিক। ডিসেম্বরই নির্বাচন হতে হবে এমন কোনো অনড় অবস্থান তিনি নেননি। নির্বাচনের সময় নিয়ে উভয় পক্ষের নমনীয়তায় আপাতদৃষ্টে সৃষ্টি হওয়া দূরত্বের অবসান ঘটিয়েছে।

বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে বিচার এবং সংস্কারের বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন, সংস্কার, ফ্যাসিবাদীদের বিচার-এ তিন বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছেন। গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের কাছে জনগণ এবং রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশাও তা-ই ছিল। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রাজনীতি এ দেশে শুধু নির্বাচনের সংস্কৃতি ধ্বংসই করেনি, সেই সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছিল। আমরা আশা করি, একটি স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ভিন্ন অন্য কোনো পথ খোলা নেই। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়েই দেশে ফিরে আসবে স্থিতিশীলতা এবং প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের সরকার।

রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন প্রকার সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে। যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা দৃঢ় আশা ব্যক্ত করতে পারি। ফ্যাসিবাদীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। তবে বিচার একটি দীর্ঘ এবং চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এ বিচার প্রক্রিয়া অবশ্যই এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবেন। মনে রাখতে হবে, সুদীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন এবং গণ অভ্যুত্থানে সহস্র মানুষের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একমাত্র তাদের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন সম্ভব। নয়তো জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ হয়ে রইব। তবে সংস্কার এবং বিচার যা-ই বলি না কেন সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার মানেই জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটি সরকার। ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে আওয়ামী লীগ যে অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই ছিল দীর্ঘ সংগ্রাম এবং গণ অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। তারেক রহমানের নেতৃত্বে একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতেই জেলজুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন বিএনপির লাখ লাখ নেতা-কর্মী। যে লক্ষ্যে তাদের এ আত্মত্যাগ, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই তা অর্জিত হওয়া সম্ভব।

লন্ডনের বৈঠকের মধ্য দিয়ে সে লক্ষ্য অর্জনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করল বিএনপি। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশকেই বরাবরের মতো এগিয়ে রাখলেন তারেক রহমান। বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের গতিশীল নেতৃত্ব ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের এ সৌহার্দ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা। গণতন্ত্র জয়ী হলে জয় হবে বাংলাদেশের, জয় হবে জনগণের। এখন প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকার নিজ অবস্থান অটুট রেখে আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন আয়োজনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করবে এবং সেই নির্বাচনি উৎসবে শরিক হবে দেশের সব গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল।

লেখক : গবেষক এবং রাজনীতি বিশ্লেষক।