মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা এবং নজরদারি করার জন্য র্যাবের কেনা সরঞ্জাম আটকে দিয়েছে সুইজারল্যান্ড।
এ বিষয়ে র্যাব ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিও দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া শেষে জাহাজীকরণের আগ মুহূর্তে চালানটি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, একটি মানবাধিকার সংস্থা র্যাবের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছে। এ কারণে ঝামেলা হচ্ছে। তবে কোন সংস্থা রিপোর্ট দিয়েছে সেটা জানি না।
দরপত্র অনুসারে, নজরদারির জন্য যে প্রযুক্তি বা সরঞ্জাম র্যাব কিনছে সেটা ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল সাবস্ক্রাইবার আইডেনটিটি (আইএমএসআই) ক্যাচার নামে পরিচিত। এগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী গুপ্তচর সরঞ্জাম। এর মাধ্যমে মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা হয়। এই প্রযুক্তি সহজে বহনযোগ্য এবং গাড়িতে ব্যবহারের উপযোগী।
চিঠির ব্যাপারে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি ক্রয়ের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ওয়েবসাইটে গত বছরের ৬ জানুয়ারি নতুন করে ইউএইচএফ ট্রান্সমিটার অ্যান্ড সার্ভেইলেন্স ইকুইপমেন্ট আইএমএসআই ক্যাচার কেনার দরপত্র আহ্বান করে র্যা। দরপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি।
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। যাচাই-বাছাই শেষে জার্মানির ইউরোপাল এগ্রিলিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ আদেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় প্রতিনিধি এমএম ট্রেডার্স। তারা সুইজারল্যান্ডের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নিওসফট থেকে নেওয়া গোয়েন্দা সরঞ্জাম র্যাবের কাছে সরবরাহ করবে।
আইএমএসআই ক্যাচার সম্পর্কে বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ফোনের ব্যবহৃত নেটওয়ার্কে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই প্রবেশ করা যায়। এই প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠানো বেতার তরঙ্গ প্রথমে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর আইএমএসআই (সিম) দখল করে নেয়। প্রতিটি সিমের একটি মাত্র কোড থাকে।
এরপর দখল করা সিমে একটি সংকেত পাঠানো হয়। ফোন ব্যবহারকারী বুঝতে পারেন না যে এটা কোন নেটওয়ার্ক থেকে আসছে। পাঠানো সংকেত গ্রহণ করার পরই ফোন সেটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ওই প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এভাবে আইএমএসআই ক্যাচার ব্যবহার করে হাজার হাজার মোবাইল ফোনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধির কার্যালয় সূত্র জানায়, র্যাবের নজরদারি সরঞ্জাম কেনার খবর জেনে যায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল। নজরদারি সরঞ্জামের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থার জন্য বিশ্বব্যাপী
প্রচারণা চালাচ্ছে এই সংস্থাটি। ‘কোয়ালিশন এগেইনস্ট আনলফুল সার্ভেলেন্স এক্সপোর্ট অর্থাৎ বেআইনি নজরদারি সরঞ্জাম রপ্তানিবিরোধী জোট’ বলে তাদের একটি আন্তর্জাতিক জোটও রয়েছে। চুক্তি হওয়ার পর র্যাবের একটি দল সুইজারল্যান্ডে ওই সরঞ্জামগুলো দেখতে যায়। এ সময় তাদের পেছনে আড়ি পাতে প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখে র্যাব কর্মকতাদের সঙ্গে প্রযুুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিওসফট কর্মকর্তাদের বৈঠক, হোটেলে অবস্থান ও বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগের চিত্র ধারণ করে প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল। এমনকি দরপত্রের বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে থাকা ই-মেইল ঠিকানায় যোগাযোগ করা হলে কোনো সাড়া দেননি।
প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়, র্যাবের বিরুদ্ধে নৃশংসতা আর নির্যাতন চালানোর রেকর্ড আছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের হাতে সাত শতাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- হয়েছে।
যদি এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সঠিক হয়, তা হলে সরঞ্জামগুলোর রপ্তানি থামানো বাঞ্ছনীয়। তারা সরঞ্জাম রপ্তানির মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশ না হওয়ার জন্য সুইজারল্যান্ড সরকারের প্রতি আবেদন জানান। এরপরই সরঞ্জাম সরবরাহে বিলম্ব শুরু হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে টেলিফোনে আড়ি পাতা বৈধ। টেলিযোগাযোগ আইনের ৯৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, ধারণ বা এ-সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহে সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাকে কোনো ক্ষমতা দিতে পারবে।’
র্যাবের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, র্যাবের ব্যবহার করা গোয়েন্দা সরঞ্জাম ইউএইচএফ ট্রান্সমিটার অ্যান্ড সার্ভেইলেন্স ইকুইপমেন্টটি ব্যবহারের অনুপযোগী। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর এটি অকেজো ঘোষণা করা হয়। সরকারি অনুমোদনের পর আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নতুন আরেকটি যন্ত্র ক্রয়-প্রক্রিয়া শুরু হয়। একইভাবে এটি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রাকজাহাজীকরণের বিষয়টিও অনুমোদন করা হয়। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া মেনে কেনাকাটা সম্পন্ন করার একপর্যায়ে র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে একটি মানবাধিকার সংস্থা সংবাদ প্রচার করে। সেই সংবাদের ওপর ভিত্তি করে উৎপাদনকারী দেশ সুইজারল্যান্ড জাহাজীকরণ প্রক্রিয়া আটকে দেয়। এসব সরঞ্জাম না থাকায় গোয়েন্দা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করে র্যাব।