কামারুজ্জামানের রিভিউ শুনানি সোমবার

SHARE

kamruzzamanমানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদনের শুনানি সোমবার অনুষ্ঠিত হবে।

রোববার শুনানির এ দিন ধার্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চে রিভিউ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

গত বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) সকালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল মামলার চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনটি দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা।

দুপুরে চেম্বার বিচারপতির আদালতে শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানিয়ে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে আসামিপক্ষে কেউ আদালতে হাজির ছিলেন না। পরে শুনানির দিন ধার্যে আদেশের দিন রোববার ধার্য করে দেন।

মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চেয়েছেন আসামিপক্ষ।

রিভিউ আবেদন বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানান, রিভিউ আবেদন দাখিল হওয়ায় আপাতত কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা স্থগিত থাকবে।

মাহবুবে আলম বলেন, আমি মনে করি না, রিভিউয়ে আপিল বিভাগের রায় পরিবর্তিত হবে। কারণ, চূড়ান্ত রায়ে অপরাধ যে হয়েছে ও তাতে আসামির দায় নিয়ে চার বিচারপতিই একমত হয়েছেন। একজন শুধু দণ্ডের বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।

রিভিউ শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে নেতৃত্ব দেবেন রাষ্ট্রের এই প্রধান আইন কর্মকর্তা।

অন্যদিকে কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন রিভিউ দাখিলের পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, আপিল মামলার রায়ে একজন বিচারপতি ফাঁসির আদেশের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তার পয়েন্টগুলো ধরেই আমরা রিভিউ আবেদনের শুনানি করবো।

কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ শুনানিতে নেতৃত্ব দেবেন তার এই প্রধান আইনজীবী।

খন্দকার মাহবুব বলেন, ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে চার্জশিটভুক্ত (ফরমাল চার্জ) দশজন সাক্ষীর বাইরে রাষ্ট্রপক্ষের নতুন তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল। এটা আমার একটা বড় প্রশ্ন।

দেশের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে রিভিউ নিষ্পত্তিতে তাড়াহুড়া না করতে ও সময় নিয়ে শুনানি গ্রহণ করতে বিচারপতিদের কাছে আবেদন জানান তিনি।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামান কারাগারে তার মৃত্যু পরোয়ানা ও আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় জানার পর থেকে রিভিউ আবেদন করতে ১৫ দিন সময় পাবেন বলে জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ হিসেবে ১৫ দিন পূর্ণ হওয়ার শেষ দিন ৫ মার্চই রিভিউ আবেদন করেন তার আইনজীবীরা।

এর আগে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের রায়কে উদ্ধৃত করে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই রায় কার্যকরে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এখন রিভিউ করায় সে প্রস্তুতি স্থগিত থাকবে এবং রিভিউ নিষ্পত্তির পর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকলে রায় কার্যকরে আর কোনো বাধা থাকবে না। অবশ্য ফাঁসির আদেশ বহাল থাকলে এরপর থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করতে সাতদিন সময় পাবেন আসামি।

বুধবার (৪ মার্চ) ও গত ২১ ফেব্রুয়ারি দু’দফায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার পরামর্শ নিয়ে রিভিউ প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন তার আইনজীবীরা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর থেকে রিভিউ চূড়ান্ত করার কাজ শুরু করেন তারা।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের সঙ্গে কারাগারে দেখা করে এসেছেন তার পরিবারের সদস্যরাও।

বুধবার কামারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা ও সময় দেওয়া হয়, আমরা আশা করবো, কামারুজ্জামানের রিভিউয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।

রিভিউ আবেদনে ন্যায়বিচার পাবেন বলে কামারুজ্জামানও বেশ আশাবাদী বলেও উল্লেখ করেন এই আইনজীবী।

তাজুল বলেন, কামারুজ্জামান শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে বেশ দৃঢ় রয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে যে রায় দেওয়া হয়েছে তাতে তিনি ন্যায়বিচার পাননি।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ তিন বিচারপতি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।

পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আইজিপি (প্রিজন) এর বরাবরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠান।

পরে কারাগারে কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়।

গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন কামারুজ্জামান। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এই বাহিনী ওই অঞ্চলজুড়ে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা মোট ৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মধ্যে সোহাগপুর গণহত্যার (৩ নম্বর অভিযোগ) দায়ে চূড়ান্তভাবে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করলেও এ অভিযোগে তিনি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পক্ষে মত দেন। সেই সঙ্গে ১, ২, ৪, ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও  বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সর্বোচ্চ সাজার পক্ষে মত দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামির দণ্ড নির্ধারিত হয় মৃত্যুদণ্ড।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার (৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি। এ অভিযোগে ট্রাইবুন্যাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সাজা কমিয়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

এ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়।

দারাসহ ছয় হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন ও অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের (২ নম্বর অভিযোগ) দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এ সাজাও বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

তবে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান হত্যার (১ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন কামারুজ্জামান। এছাড়া ৫ নম্বর (১০ জনকে হত্যা) ও ৬ নম্বর অভিযোগে (টুনু হত্যা ও জাহাঙ্গীরকে নির্যাতন) ট্রাইব্যুনালের রায়ের সঙ্গে একমত হয়ে আপিল বিভাগও খালাস দিয়েছেন।