টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড গ্রিস গণভোট

SHARE

greec flagগণতন্ত্রের সূতিকাগার গ্রিসে আজ গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা। গণভোটে ‘হ্যা’, ‘না’ রায় দিয়ে গ্রিকরা নির্ধারণ করবে তাদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির সুদূরপ্রসারী ও জটিল সমীকরণ। যে কারণে গ্রিসের গণভোট আজ ‘টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ হয়ে উঠেছে।

যে কারণে গণভোট

ইউরোপ মহাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য গ্রিস। রাষ্ট্র পরিচালনায় ইইউর সদস্যদেশ এবং আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ নেয় দেশটি। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার সময় থেকে ঋণের বেড়াজালে আটকে একপ্রকার দেউলিয়া হয়ে পড়ে গ্রিস। মন্দা মোকাবিলা করতে দেশটির সরকার ভর্তুকি খাতগুলোর অধিকাংশ বন্ধ করে দেওয়া শুরু করে। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় অস্টারিটি বা কৃচ্ছ্রসাধন। বিদেশি দাতারা চায় আরো কঠোরভাবে কৃচ্ছ্রসাধন করুক গ্রিস। কিন্তু বর্তমান সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বেকার হয়ে পড়া ২৫ শতাংশ লোকের ভাগ্য অনিশ্চয়তায় ফেলতে চায় না। বয়স্ক ভাতাসহ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় সেবাও বন্ধ করতে চায় না। এসব নিয়ে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে চরম মতবিরোধের মুখে পড়ে দেশটি। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় রয়েছে গ্রিস। বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর কাছে নতুন করে ঋণসহায়তা না পেলে অবস্থা আরো শোচনীয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঋণসহায়তা নবায়নের পদ্ধতির নাম বেইল-আউট। ইতিমধ্যে বেইল-আউটের সময়সীমা ৩০ জুন পার হয়েছে। বেইল-আউটের প্রস্তাবে বিস্তর ফারাক থাকায় বিদেশি দাতাদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করতে পারেনি গ্রিস। এই অবস্থায় সরকার কী করবে, তা জনগণের কাছে জানতে চেয়ে গণভোট দিয়েছে। আজ রোববার সেই গণভোট।

গ্রিসের স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৭টা (বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার কাছাকাছি) থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার কথা। গণভোটের পক্ষে-বিপক্ষে শনিবার বিশাল র‌্যালি ও জনসভা হয়েছে। এই অবস্থায় দুটি স্পষ্ট মতবাদে বিভক্ত হয়ে পড়েছে গ্রিস। বিদেশি দাতাদের শর্ত মেনে ঋণসহায়তা নেওয়া অথবা না নেওয়া। গ্রিস সরকার ‘না’-এর পক্ষে। আর বিরোধী দলগুলো ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে। ছোট্ট দেশ গ্রিসের জনসংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখের মতো। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি লোক আজ গণভোটে অংশ নেবেন। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, দেশটিতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে অনেক বেশি। ফলে বয়স্ক মানুষের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে সরকারকে পেনশনসহ নানা রকম সুযোগ নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু বিদেশি দাতারা বলছে, জনগণের ভাগ্য জনগণই নিশ্চিত করুক, সরকারের এখানে তেমন কিছু করার নেই।

ফলাফলের প্রভাব

গণভোটে যদি ‘হ্যাঁ’ পক্ষ বিজয়ী হয়, তবে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর শর্ত মেনে ঋণ নেবে গ্রিস। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ‘হ্যাঁ’ বিজয়ী হলে গ্রিসের বর্তমান সমাজতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকবে কি থাকবে না। ঋণ নেওয়ার পক্ষে মতামত দেওয়া মানে প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাসের সরকারকে প্রত্যাখ্যান করা। একই সঙ্গে ইউরোপীয় নেতাদের চাপিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার চালানোর পক্ষে হয়তো যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পাবেন না সিপরাস ও মন্ত্রিসভা। এই অবস্থায় পদত্যাগ করতে পারে সিপরাস সরকার।

যদি ‘না’ পক্ষ বিজয়ী হয়, তবে তাকে সরকারের জয় হবে। এই অবস্থায় মুদ্রা ব্যবস্থায় ইউরো প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে গ্রিসের। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিতে পারে দেশটি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে নতুন চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে সিপরাস সরকারকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন ঋণের সন্ধান করতে হবে তাদের। না হলে দেশ চালানো সম্ভব হবে না। চলতি অর্থবছরে সরকার চালাতে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দরকার গ্রিসের। এই অর্থ জোগাড় করা দেশটির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও ইউরোপীয় নেতারা আশার কথা শুনিয়েছেন। গণভোটের পরেও বেইল-আউট নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করতে চান তারা। কিন্তু এটি গণভোটের রায় প্রভাবিত করার জন্যই বলা হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেছে।

সংকটের নেপথ্যে

গ্রিসে বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে সিরিজা পার্টি। এই দলটি কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা। বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০০০ সালের পরে গ্রিসে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো একটু একটু করে জনপ্রিয়তা কুড়াতে থাকে। এরপর ২০০৮ সালে মহামন্দার মুখে সমাজতন্ত্রীরা জনগণের আরো কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। জনগণের অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সরকারের সমালোচনা করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বামপন্থিরা। এরপর স্থানীয় নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে তারা। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সিরিজা পার্টি।

সিরিজা পার্টির জয়ের সময় থেকেই বলা হচ্ছিল, সমাজতান্ত্রিক সিরিজা নেতারা হয়তো ইইউর সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়বেন। কারণ, ইউরোপের বুকে কট্টর সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা কখনোই মেনে নেবেন না এই মহাদেশের ক্যাপিটালিস্ট নেতারা। শেষ পর্যন্ত তা-ই বাস্তবে পরিণত হলো। এই অবস্থায় গ্রিসের গণভোটকে বলা যেতে পারে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে লড়াই। তবে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। কিন্তু কে জিতবে- সমাজতন্ত্র, না পুঁজিবাদ? আগাম জরিপে ‘না পক্ষ’ এগিয়ে থাকলেও সঠিক উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত।