প্রাণ বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর শরণাপন্ন হতে দর্শনার্থীদের লাইনে দাঁড়ান মেনন

SHARE

স্বাধীনতাত্তোর প্রাণ রক্ষার তাগিদে জাতির পিতার শরণাপন্ন হয়েছিলেন রাশেদ খান মেনন। সেদিন মুজিব বাহিনীর সশস্ত্র হুঙ্কারে প্রচন্ড ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়া মেননের সঙ্গী হয়েছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। মুজিব বাহিনীর সশস্ত্র যোদ্ধাদের হাতে তখনো মারণাস্ত্র। তাদের স্রেফ ঘোষণা পিংকীপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের সমূলে নিধনের। স্বভাবতই এ ঘোষণায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন ষাটের দশকের তুখোড় দুই ছাত্রনেতা। কাজী জাফর- মেনন দুই নেতাই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্ণধার। ষাটের দশকের শুরুতেই ডাকসু ভিপি হওয়া রাশেদ খান মেনন,কাজী জাফর ও হায়দার আকবর খান রণো এই “ত্রিরত্ন” মুজিব বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধুর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ অবলম্বন করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িটি একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় ধানমন্ডির পুরাতন ১৮ নম্বর (নতুন ৯/এ সড়কস্থ একটি ভাড়া করা বাড়িতে উঠেছিলেন। বাড়িটিকে ঘিরে দলে দলে দর্শনার্থীর উপচে’ পরা ভিড়।

একদিন সাতসকালে মেনন-জাফরও সাধারণ দর্শনার্থীদের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন চারদিকে সর্তক দৃষ্টি রেখে। ঠিক এসময় বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ জামাতা শেখ হাসিনার স্বামী ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া। মূহুর্তে তার দৃষ্টিগোচরে পড়লো সাধারণ দর্শনার্থীদের কাতারের দন্ডায়মান রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফর আহমেদ। তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রসংসদের ভিপি ছাত্রলীগ নেতা ওয়াজেদের সঙ্গে আগে থেকেই একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। সেই সূত্র ধরে এগিয়ে গেলেন এবং দুই কমিউনিস্ট নেতাকে লাইন থেকে টেনে বের করলেন।

ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাদের মুখে আতঙ্কের কথা শুনে নির্ভয় দিলেন। নিয়ে গেলেন তাদের বাড়ির ভেতরে। ডঃ ওয়াজেদ নীচের কামরায় বসিয়ে দোতলায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে বললেন “আব্বা রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফর আপনার সাক্ষাৎ প্রত্যাশী। ওরা বিপদে পড়ে আপনার দ্বারস্থ হয়েছে। পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের খতমের ঘোষণা দেয়ায় আপনার অনুকম্পা লাভের জন্য এসেছেন। চীন পন্থী হলেও ওরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি এল এফ) অর্থাৎ মুজিব বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করলেন মেনন-জাফর। তারা কক্ষে প্রবেশের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপরত ছিলেন মুজিব বাহিনীরই অন্যতম অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মুজিব দুই নেতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। আর বললেন, “তোমরা যে পন্থীই হও না কেনো, তোমাদের ওপর আমার আস্থা আছে। সদ্য প্রাপ্ত স্বাধীনতাকে সুসংহত করতে তোমরা আমাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করো।এটা দেশপ্রেমিক যুবনেতা হিসাবে তোমাদের নৈতিক দায়িত্ব, যা তোমরা কোনভাবেই এড়াতে পারবে না।” শেখ ফজলুল মনিকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং মুজিব বাহিনীর শীর্ষ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আসম আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজকেও সহ অবস্থানের নির্দেশনা দিলেন বঙ্গবন্ধু।

তৎকালীন ন্যাপ ভাষানী নেতা রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর, হায়দার আকবর খান রণোসহ পিকিংপন্থী নেতারা স্বাধীন দেশে স্বস্তি নিয়েই আবারো রাজনৈতিক মাঠে বিচরণ করেন এবং অচিরেই সক্রিয় তৎপরতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে – গোপনে নানা ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে পড়েন। রাশেদ খান মেনন তার জীবনে আরও একবার প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। “৯৬ সালের কথা। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি পল্টনে তার ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলি বুকে বিদ্ধ হলেও অলৌকিকভাবে প্রাণে রক্ষা পান মেনন। ” রাশেদ খান মেনন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা আব্দুল জব্বার খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার ছিলেন।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নরঘাতক ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চের গণহত্যার সর্মথন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদোহী ও দুষ্কৃতকারী হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব নগর সরকারকে সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানি কসাই টিক্কা খান এবং পরে ডাঃ মুত্তালিব মালিক গভর্নর হলে গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) গিয়ে অভিনন্দন জানান। কমিউনিস্ট হিসাবে রাশেদ খান মেনন যেমন সহকর্মীদের সঙ্গে আদর্শগত বৈপরীত্যের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন, ঠিক তেমনিভাবে পারিবারিকভাবেও তারা আদর্শগত বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন।

রাশেদ খান মেননের এক ভাই এনায়েত উল্লাহ খান ছিলেন জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকারের মন্ত্রী। আরেক ভাই ওবায়দুল্লাহ খান করেছেন জেনারেল এরশাদের মন্ত্রীত্ব। আর বোন সেলিমা রহমান ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রী। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানও তিনি। দলীয় নেতৃত্বের মতদ্বৈধতায় রাশেদ খান মেননের জুরি নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ এর সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরকার উৎখাতের ঘোষণা দিয়ে হুঙ্কার ছুঁড়ে দিলেন,এই বলে যে, তিনি নতুন পতাকা ওড়াবেন। মাওবাদী লেলিনবাদী উগ্র সংগঠনগুলো গুম হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হলো। ন্যাপ ছিলো একটি মিশ্র সংগঠন।

আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা ভাসানীর ছায়াতলে সমবেত হলেন। এর আগে “৭২ সালেই কাউন্সিল করে ভাসানী নিজে সভাপতি ও কাজী জাফরকে সাধারণ সম্পাদক করেন। কিন্তু অচিরেই আবার তা ভেঙ্গে দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী কারামুক্ত ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করলেন। ” ৭৪ সালে এরকম অবস্থায় রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফর ন্যাপ ভাসানী ত্যাগ করে গঠন করলেন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউ পি পি) আরো একটা ভাঙ্গন হলো – ডাঃ আলীম আল রাজীর নেতৃত্বে তিনি দলের নাম দিলেন বাংলাদেশ পিপলস লীগ। “৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মওলানা ভাসানী মৃত্যুবরণ করলে ” ৭৭ সালে ন্যাপের সভাপতি হলেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক হলেন এস এ বারী এ টি। এ দুই নেতাই মন্ত্রীত্বের টোপ গিলে ন্যাপের কবর রচনা করেন।

“৭৮ সালে লেলিনবাদীরা কমিউনিস্ট কংগ্রেসে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। হায়দার আকবর খান রণো সাধারণ সম্পাদক হলেও ” ৮৪ সালে নজরুল ইসলাম তাকে হটিয়ে নিজেই পদ দখল করেন। অপরদিকে কাজী জাফর এরশাদের প্রধানমন্ত্রীত্ব করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন জাতীয় পার্টির একাংশের নেতা। “৮৫ সালে আবুল বাশারের মজদুর পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টি একীভূত হয়। ৯১ নির্বাচনে বরিশাল-২ আসন থেকে রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে ” ৯৬ সালের নির্বাচনে জামানত হারান। বিগত তিনটি নির্বাচনে তিনি রাজধানীর মতিঝিল থেকে নৌকা প্রতীকের বদৌলতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশ বছর মন্ত্রীত্ব করেন। বর্তমান মেয়াদে মন্ত্রীত্ব লাভে ব্যর্থ হয়ে অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়েছেন রাশেদ খান মেনন। ক্যাসিনো কেলেংকারীর সঙ্গে জড়িয়ে বহুল বিতর্কিত। সরকারের শুদ্ধি অভিযানের তীর এখম তার দিকে।