বিপ্লবের কাছে সহবত শিখুন

SHARE


ত্রিপুরায় গেরুয়ার কাছে লাল পরাজিত হয়েছে। গণক বা গুনিনরা যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তেমনই ঘটেছে। জোরাজুরি, কেন্দ্র দখল, এজেন্টকে মারধর—টুকটাক যে হয়নি, তা বলা যাবে না। তবে এটাও ঠিক, পুরোটাই অনেক অঙ্ক আর ভাবনাচিন্তার ফল। মানিক বাবু এত তাড়াতাড়ি সাবেক হবেন, এটা খোদ সিপিএম কেন, তৃণমূল কংগ্রেস, কেউই ভাবেনি। টাকা ঢালা হয়েছিল শিকড়সুদ্ধ গাছ অন্যের বাগান থেকে তুলে এনে, সার-পানি দিয়ে নিজের গাছ বানিয়ে তাতে ফুল-ফলে ভরিয়ে তুলে গেরুয়া রং দেওয়ার জন্য। চেনাই যাবে না যে অন্যের বাগান অন্য মালির হাতে এসব গাছ বীজ থেকে চারা হয়ে সেসব বাগানকে ফুল-ফল দিয়েছিল একসময়।

সেদিনের ছেলে দিল্লিপ্রবাসী বিপ্লব দেবকে এখন দেখতে মানুষের ঢল। আগরতলার বাংলাদেশ মিশন বা ভিসা অফিসের রাস্তাতেই তাঁর বাড়ি, যে রাস্তায় এখন ঢোকাই মুশকিল। সারা সপ্তাহ ভিসাপ্রার্থী মানুষের ভিড়ে এমনিতেই রাস্তাটা সকাল-সন্ধ্যা গমগম করে। এখন রাতদিন নেই শনি-রবি নেই। একাত্তরে শরণার্থী মায়ের গর্ভে থাকা আর ভূমিষ্ঠ হওয়া বাংলাদেশের প্রায় শিশুর নাম যেমন হয়েছে ‘বিপ্লব’ নয় ‘স্বাধীন’ কিংবা ‘মুজিব’ অথবা ‘জয়’, তেমনই একজন এই বিপ্লব। বিপ্লব দেব—তিনিই হয়তো মুখ্যমন্ত্রী হবেন। বেশির ভাগ মানুষের আশার প্রতিফলন হবে তাতেই। কিন্তু রাজনীতিতে সব সময় সব আশার প্রতিধ্বনি শোনা মানা আদিবাসীদের দল আর বিজেপির প্রধান ঘাঁটি ত্রিপুরার আইপিটিএফ ইতিমধ্যেই বড় কুরসিটা দাবি করেছে। এই দলের নেতা নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা বা এন সি ডির হক দাবি, ‘আমাদের ছাড়া বিজেপি কিছুই করতে পারত না। তাই ওই কুরসি আমাদেরই। আমাদের আদি দাবি, ত্রিপাল্যান্ড।’ মােন ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরাকে আরও খণ্ডিত করে অন্য একটা রাজ্য এখনই চাই।’ বিজেপি এখন রগড় দেখবে না দেখাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে বিপ্লব যে লাইম লাইটে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁকে নিয়ে কুমিল্লা, চাঁদপুর, কচুয়াতেও মানুষের মনের মধ্যে একটা উৎসব উৎসব ভাব। উৎসব আর আনন্দের ভাব মনের মধ্যে সুপ্ত থাকেনি, মিষ্টি খাওয়া দিয়ে তা প্রকাশিতļহয়েছে।

এপার-ওপার দুপারের মানুষই খুশি; খুশির জোয়ারে মাথা ঠিক রাখা বেশ কঠিন। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিজেপির প্রধান সিপাহসালার সাবেক কংগ্রেসি ‘নও’ বিজেপি হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ভারতের সবচেয়ে সাদামাটা মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বচ্ছতার প্রতীক মানিক সরকারকে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার জন্য বকাবাজিতে মত্ত হয়েছেন। টাকার গরমে যেমন মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, ক্ষমতার গরমেও তেমনটি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। সেটাই হয়েছে হিমন্ত আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের। ত্রিপুরার গ্রামেগঞ্জে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। বুলডোজার দিয়ে লেলিনের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। গুঁড়িয়ে দিচ্ছে কার্ল মার্ক্সের আবক্ষ। চারদিকে কেমন একটা অশান্তির ধুয়া—ভয় পেয়ে মানুষের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার খবরও আসছে। আমাদের যারা ভোট দেয়নি, আমাকে যারা ভোট দেয় না, তারা চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাক। তাদের সম্পদ এখন আমাদের ভোগের বস্তু। এই মনোভাব এপারে যেমন চাড়া দিয়ে ওঠে, ওপারেও তেমন চাড়া দিচ্ছে।

আশার কথা, বিপ্লব দেব এখনো মাথা ঠান্ডা রেখে স্বাভাবিক আচরণ করছেন। শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত মন্ত্রী খগেন্দ্র জমাতিয়ার কফিনবন্দী লাশকে। আগরতলার সিপিএম পার্টি অফিসের স্বল্প পরিসরে খুবই সাদামাটা এক অনুষ্ঠানে—খগেন্দ্র জমাতিয়ার লাশ যেন একটা প্রতীকী লাশের পরিণত হয়েছে। এ লাশ যেন সিপিএমের লাশ। সবারই মন খারাপ। মরদেহে মালা দিয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা মানিক সরকারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। কোনো রাজনৈতিক সেলফি তোলার জন্য এই পা ছোঁয়া নয়। এটা প্রায় বাবার বয়সী একজন সদা স্বচ্ছ মানুষের প্রতি আরেক মানুষের শ্রদ্ধা। ফলবান বৃক্ষের মাটির দিকে ঝুঁকে থাকার যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য। বিনয় মানুষকে মানুষ করে। যিনি বিনয়ী, তিনি হারান না কিছুই। বরং তাঁর ঝুলিতে এসে জমা হয় অন্যের শ্রদ্ধা, আদর ভালো লাগা, ভালোবাসা। প্রণামের জবাবে মানিক বাবুও বিপ্লব দেবের পিঠে আশীর্বাদের হাত রাখেন। বিপ্লব দেব প্রয়াত মন্ত্রী খগেন্দ্রের শোকবিহ্বল ছেলেকেও কাছে টেনে সান্ত্বনা দিয়েছেন। এসবই বিনয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সঠিক রাজনৈতিক আর সামাজিক আচরণ। যে বিপ্লবকে আজ আমরা ‘আমাদের ছেলে’ ‘আমাদের ছেলে’ বলে মুখে ফেনা তুলছি, তাঁর নামে মিষ্টিমুখ করার আগে আহা, আমরা যদি তাঁর শিষ্টাচার আর সহবতের একটা তালিম নিতাম। চাঁদপুরে কচুয়ার আরেক সন্তানের দাবিদার দালানে ধাক্কা দেওয়ার তত্ত্বের আবিষ্কারক সাবেক জাঁদরেল আমলা এবং মন্ত্রী নাকি বলছেন, ‘হবে না, আমাদের ছেলে যে।’ মানুষকে অবজ্ঞা করে, ছোট করে, অবহেলা করে কথা বলা এবার হয়তো তিনি বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে বন্ধ করবেন। প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হাততালি দিয়ে হাসবেন না। ব্যাংক লুটে আমির হওয়ার পথে হাঁটবেন না। এসব করলে কচুয়ার সন্তান বিপ্লবের অসম্মান হবে।