ট্রাম্পের যুদ্ধপ্রবণতা ও শান্তি

SHARE


গত বছর ট্রাম্প যখন গদিতে বসেন, তখন অনেক পণ্ডিতের বিশ্বাস ছিল তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে থিতু হবেন এবং স্বাভাবিক আচরণে ফিরে আসবেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিশালসংখ্যক মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এভাবে বিষয়টিকে দেখেননি। তাঁরা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ট্রাম্প স্পষ্টতই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত একজন লোক; দায়িত্বের চাপে এই সমস্যা আরও বাড়বে এবং এটা তাঁকে যুদ্ধের দিকে, এমনকি পরমাণু যুদ্ধ বাধানোর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এখন ইরান অথবা উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে। এখন অনেক দেরি হওয়ার আগেই এই মার্কিন প্রেসিডেন্টের রাশ টেনে ধরা বিশ্বের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
বহু মনোবিজ্ঞানী ও মনস্তাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে ট্রাম্প শুধু যে একজন জ্বালাতনকারী, প্রদর্শনপ্রিয় ও মিথ্যাবাদী লোক, তা-ই নয়; তিনি এর চেয়েও বেশি মানসিক বৈকল্যগ্রস্ত লোক, যিনি আবেগতাড়িত, আগ্রাসী ও নির্মমভাবে নিজের সুবিধা হাতিয়ে নেন এবং অন্যদের সারাক্ষণ দোষারোপ করার তালে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, এ বছরের শুরুতে
ওয়াল্টার রেড আর্মি মেডিকেল সেন্টারে ট্রাম্পের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা ঠিক আছে বলা হলেও আদতে এখন তাঁর অবস্থা অনেক খারাপ। এ কারণে তাঁরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্রাম্পের মানসিক স্বাস্থ্য নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মূল্যায়ন করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে যাঁদের ধারণা নেই, তাঁদের এবং অবশ্যই বহু আমেরিকানের কাছে মানসিক বৈকল্যের লক্ষণকে শক্তিমত্তা বলে মনে হতে পারে। আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার অভাবকে ভুলবশত স্পষ্টবাদিতা বলে মনে হতে পারে। আগ্রাসন ও অসৎভাবে কর্মসিদ্ধিকে ভুলবশত পরিস্থিতি সামলানোর কৌশল মনে হতে পারে। কিন্তু পেশাদার মনোবিজ্ঞানীদের কাছে এই প্রবণতাগুলো ভয়ানক লক্ষণ। এ ধরনের আচরণ যাঁরা করেন, তাঁরা সাধারণত তাঁদের ক্ষমতা হারানোর ভয়ানক ও অসহিষ্ণুতা মুখোশের আড়ালে রাখতে চান। যে কর্মকাণ্ড সহিংস ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি করতে পারে, তার বৈধতার অনুমোদন আদায়ে তাঁরা জোরজারি করতেও পিছপা হন না।
অতিপ্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিত্ব ও বদমেজাজি নেতা বিশ্বে এই প্রথম এসেছেন তা নয়; কিন্তু এই জাতের শাসকেরা সাধারণত তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছেন অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোয়; যে দেশগুলোয় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনী ছিল না। এমন অনেক উপাখ্যানের নির্মমতা এখনো আমাদের সামনে জ্বলছে। ইদি আমিন, সাদ্দাম হোসেন, পল পট এবং আরও অনেকের পক্ষে দীর্ঘদিন নির্মম শাসন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
ট্রাম্প তাঁদের জাতের নন। তাঁদের চেয়ে তাঁর হাতে অনেক ক্ষমতা। ব্যক্তিগত নির্দেশেই তিনি গোটা বিশ্বকে ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধে নিমজ্জিত করে ফেলতে পারেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ট্রাম্প উপর্যুপরি এই ক্ষমতা ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন। তিনি মনে করছেন, হুমকি-ধমকি, নিষেধাজ্ঞা ও বাহাদুরি দেখিয়ে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি থেকে সরিয়ে রাখা যাবে। আদতে তিনি উত্তর কোরিয়াকে যত বেশি কোণঠাসা করছেন, তত বেশি যুদ্ধের উসকানি দেওয়া হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়া বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে তাদের কঠোর অবস্থান নিতে হচ্ছে। সম্প্রতি অলিম্পিক ইস্যুতে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে, যা সবাইকে আশান্বিত করেছে। কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়; ট্রাম্প শিগগিরই দুই দেশের মধ্যে আবার উত্তেজনা উসকে দেবেন। আসলে তিনি নিজেকেও সাহায্য করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন।
ইরান এখন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় দৃষ্টিকেন্দ্র। যে কট্টরবাদীরা ট্রাম্পকে ঘিরে আছেন, তাঁরা এখন ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সামনে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চাইছেন। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকারও একই কাজ করার জন্য ট্রাম্পকে ঠেলছে। ট্রাম্প এবং তাঁর উপদেষ্টারাও ভাবছেন হুমকি-ধমকি দিলে ইরান তার প্রতিবেশী সিরিয়া ও লেবানন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবে। কিন্তু এই ধারণা সর্বাংশে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কারণ, ইরানের পেছনে রাশিয়ার মৌন সমর্থন রয়েছে।
ট্রাম্পের জয়ের মোহ ও ক্ষমতার ভারসাম্য মেনে নেওয়ার অক্ষমতা ভয়ানক হুমকি সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে টুইটারে নিজেকে ‘একজন খুবই ধীর বিচক্ষণ লোক’ বলে দাবি করেছেন। এটি তাঁর শক্তি নয়, বরং দুর্বলতার লক্ষণ। এটি আশ্বস্ত হওয়ার নয়, বরং আতঙ্কিত হওয়ার মতো কথা। স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট মুয়েলারের তদন্ত যত এগোচ্ছে, ট্রাম্প ততই মানসিক ও রাজনৈতিক চাপে পড়ছেন। এই চাপ নাটকীয়ভাবে তাঁকে যুদ্ধংদেহী করে তুলতে পারে। ভয়ের কথা হলো, ট্রাম্পের সর্বগ্রাসী খায়েশ তাঁকে এমন এক অনিবার্য সংঘাতের সামনে নিয়ে যেতে পারে, যেখান থেকে তিনি চাইলেও আর ফিরতে পারবেন না। নিজেদের ভেতরের জখম ঢেকে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে ট্রাম্প ও তাঁর লোকজন যেসব বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তার অনেকগুলোই আবেগতাড়িত। ট্রাম্পের চারপাশের লোকজন তাঁর অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য প্রায়ই মাত্রাতিরিক্ত চাটুকারিতা প্রদর্শন করছেন এবং ট্রাম্পের হঠকারী আবদার মেনে নিচ্ছেন।
এই অবস্থায় মার্কিন কংগ্রেসের উচিত ট্রাম্পের একক ইচ্ছায় যুদ্ধ, বিশেষ করে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার ক্ষমতা দ্রুততার সঙ্গে বাতিল করা। সংবিধানের ৮ নম্বর সেকশনের প্রথম অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে, প্রেসিডেন্টের হাতে নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোয় প্রেসিডেন্টরা কংগ্রেসের সেই ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং দুঃখজনকভাবে কংগ্রেসও নীরবে সায় দিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে অস্তিত্বের সংকটের কথা মাথায় নিয়েই সাংবিধানিক ক্ষমতা নিজের কাছে ধরে রাখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেরই এখন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধযাত্রার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো দরকার। আমরা একটি ভয়ানক যুগে আছি। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, স্থিতিশীলতা এবং সব পক্ষের সহাবস্থানের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের কোরীয় উপদ্বীপ ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোর দরকার নেই। আমাদের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো দরকার। কিন্তু ট্রাম্প হয়তো মনস্তাত্ত্বিকভাবেই তা করতে অক্ষম; কারণ সমঝোতার বদলে আক্রমণ করাই তাঁর চারিত্রিক প্রবণতা। এখন শান্তির স্বার্থে বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ব্যান্ডি এক্স লি ইয়েল স্কুল অব মেডিসিনের আইন ও মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং জেফরি ডি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক