নারীদের চাকরি ছাড়ার অন্যতম কারণ শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের অভাব

SHARE

বেসরকারি অফিস হলেও মাতৃত্বকালীন ছুটি ‌‌‌‌‌দুই মাসই পেয়েছিলেন, যদিও এখন ছয় মাস। কিন্ত ছেলের জন্মের আগেই এক মাস ছুটি নিতে হয়। এখন ছেলের বয়স প্রায় চার বছর। ছেলেকে বাসায় রেখে অফিস করতে হচ্ছে এই মাকে। অফিসে ডে কেয়ার বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র নেই। বাসায় বিশ্বস্ত গৃহকর্মীও নেই। শাশুড়ি কাছেই বড় হয়েছে ছেলে। কিন্ত শাশুরি গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে এই মা। কিন্তু তিনি কত দিন গ্রামে থাকবেন তা অনিশ্চিত। তারপর?

হোসনে আরা মিতা বলেন, ‘এরপর কী হবে তা ভাবতে পারছি না। আশপাশে কোনো ডে কেয়ারও নেই। এখন সমাধান হিসেবে চাকরিটাই হুমকির মুখে পড়েছে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ। তবে ২০১৩ সালের জরিপে তা নেমে আসে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশে। শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার পরও শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কেন কমছে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা বাড়ছে। একক পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে। সন্তান কোথায় বা কার কাছে থাকবে এ চিন্তায় অনেক শিক্ষিত ও যোগ্য নারী চাকরিতে টিকে থাকতে পারছেন না।

প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমানে এই মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ঢাকা ও অন্যান্য জেলা শহরে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য মোট ৪৩টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। একটি প্রকল্পের অধীনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও ২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের জন্য বাড়িভাড়া, জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বেসরকারি উদ্যোগে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তবে নজরদারি ছাড়া বেসরকারি খাতকে ঢালাওভাবে এ ধরনের কেন্দ্র পরিচালনার অনুমতিও দেওয়া ঠিক নয়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছে। এতে মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া কেন্দ্র পরিচালনা করলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

সন্তানের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর (এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং) নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কর্মজীবী নারীদের জন্য সরকার ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান করেছে। বর্তমানে কিছু বেসরকারি সংস্থাও ছয় মাস ছুটি দিচ্ছে। কিন্তু ছুটি শেষে নারীরা শিশুসন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়ছেন।

বাংলাদেশের শ্রম আইন বলছে, ৪০ বা তার বেশি নারী নিয়োজিত আছেন এ রকম প্রতিষ্ঠানে ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত কক্ষের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধা থাকতে হবে। কিন্তু ৪০ লাখ নারী শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র পোশাকশিল্পসহ সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। যেগুলো আছে তাতে সরকারের নজরদারি নেই।

কয়েকজন মা এই প্রতিবেদককে বলেন, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়াতে এবং কর্মজীবী নারীদের কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের বিকল্প নেই। তবে শুধু কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, কেন্দ্রগুলোতে যাতে মায়েরা সন্তানকে রেখে নিশ্চিন্ত হতে পারেন, সে ধরনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক তাঁর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি তাঁর সন্তানকে রাজধানীর উত্তরায় একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে ভর্তি করেন। বাসায় ঘুমায় না, কিন্তু সেন্টারে গেলেই তাঁর সন্তান ঘুমিয়ে যায়। খাবারের মধ্যে কিছু মেশায় কি না তা নিয়ে সন্দেহ হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অন্য অভিভাবকেরাও এ ধরনের সন্দেহের মধ্যে আছেন। কিন্তু এ অভিযোগ নিয়ে কার কাছে যাবেন?

 আইনের খসড়া অনুযায়ী, মন্ত্রণালয় যদি মনে করে লাইসেন্স নেওয়ার পরও কেউ আইনের নিয়মনীতি মানছে না, তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স বাতিল করার বিধান রাখা হয়েছে। খসড়া অনুযায়ী, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে যুক্তিসংগত পরিসর ও সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। ৩০ থেকে ৫০ জন শিশুকে দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সেবা দিতে হবে। এ খসড়ায় উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্যও এ ধরনের কেন্দ্র পরিচালনার কথা বলা আছে।

প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, উন্নত দেশে ‘বেবি সিটিং’-এর ব্যবস্থা আছে। পাশের বাড়ির নারীই হয়তো কর্মজীবী নারীর সন্তানকে দেখভাল করছেন। ঘরে বসে ওই নারীও আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন। বেসরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থার জন্য প্রশিক্ষণ ও আইনের প্রয়োজন।