রেমিট্যান্স আয় কমছে, শ্রমবাজার দখল করছে প্রতিবেশী দেশগুলো

SHARE

101666673-US_dollar_2.1910x1000দেশে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ও রাজনৈতিক সংলাপের অনুপস্থিতিতে অস্থিতিশীল পরিবেশ সরাসরি প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে রেমিট্যান্স আয়ে। বাংলাদেশি শ্রমিক সম্পর্কে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কোরিয়া ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। রয়েছে প্রতিযোগী দেশগুলোর বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা ও অপপ্রচার। এধরনের অপপ্রচার দীর্ঘদিন ধরেই চলছে কিন্তু এর মোকাবেলা কোনো কার্যকর কৌশল গড়ে তুলতে পারেনি বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলো। এরপর দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বিদেশি নাগরিক হতাহতের বিষয়টি নতুন করে সমালোচনার সৃষ্টি করছে। এর সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো। এসব শ্রমবাজার দখল করছে প্রতিবেশি কয়েকটি দেশ। আর এ ধাক্কা সামলাতে পারছে না রেমিটেন্স আয়। এর আগে দীর্ঘ ২১ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স প্রবাহ সাড়ে ৭ শতাংশ কমে গিয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। চলতি অর্থবছরের সমাপ্তিতে তা ফের কমেছে আড়াই শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৪৯২ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। এ বছরে কম এসেছে প্রায় ৪০ কোটি ডলার, যা টাকার অঙ্কে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
রেমিট্যান্সের ৬৭ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে; গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে হারে শ্রমিক ফিরে এসেছে একই হারে যায়নি। বরং কয়েকটি দেশ শ্রমিক নেয়া প্রায় নিষিদ্ধ করেছে। এর মোকাবেলায় নতুন বাজার সন্ধান করে পাল্টা সেসব দেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানি করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরের প্রায় সারা মাসজুড়েই রেমিট্যান্স কম এসেছে। অর্থবছর শুরুই হয়েছে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। গত জুলাই মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ঋণাত্মক ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। পরের তিন মাস অর্থাৎ আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সামান্য বেড়ে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের নিচে ছিল; এরপর নভেম্বরে আবার তা নিম্নমূখী হয়ে দাঁড়ায়। ওই মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঋণাত্মক ছিল ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে সামান্য বাড়লেও জানুয়ারি থেকে একটানা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকে।
প্রতি বছর ঈদ উপলক্ষে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে তাদের আত্মীয়পরিজনের কাছে বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি রেমিট্যান্স পাঠালেও এবার তা ঘটেনি। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, তার আমলে অর্থাৎ চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেযা হয়েছিল। ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে রেমিট্যান্স আনার নীতিমালা সহজ করা হয়েছিল।
এরই ভিত্তিতে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে বেড়েছিল, যার প্রভাব পরবর্তী কয়েক বছরে ছিল; কিন্তু হঠাৎ করে গত কয়েক বছরে শ্রমবাজারের সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিক ফিরে আসতে থাকে; কিন্তু যে হারে ফিরে এসেছে সে হারে অন্য কোনো বাজারে যায়নি। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিক ফিরে আসার কারণ হিসেবে তিনি জানান, প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে যে হারে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার কথা ছিল সেই হারে হয়নি।
ফলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার দখল করেছে ভারতসহ অন্যান্য দেশ। দ্বিতীয়ত, প্রবাসীরা দেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠান ফ্যাট, বাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করার জন্য; কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অন্যান্য খাতের মতো, আবাসন খাতেও বিরাট ধস নেমেছে। কয়েক বছর ধরে আবাসিকে নতুন করে গ্যাসসংযোগ বন্ধসহ নানা প্রতিকূলতায় এ খাতের খারাপ অবস্থা বিরাজ করেছে। সব মিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তৃতীয়ত, বিনিয়োগ মন্দার কারণে ডলারের চাহিদা কমে গেছে। আর ডলারের চাহিদা কমে যাওয়ায় টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কমে গেছে। সব মিলে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী বিদেশে নতুন ধরনর শ্রমবাজারের সন্ধান ও সে অনুয়ায়ী দক্ষ লোকবল তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সাবেক এ গভর্নর জানিয়েছেন, বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বেশি রয়েছে। এ কারণে আপাতত এর কোনো প্রভাব পড়বে না, তবে যখন বিনিয়োগ চাহিদাসৃষ্টি হবে তখন বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে যাবে, এতে টান পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এখন থেকেই নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিতে বিদেশগামীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর বলেন, রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য থেকে গত কয়েক বছর ধরে যে হারে শ্রমিক ফিরে এসেছে ওই হারে যায়নি। এ কারণে মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। তিনি আশঙ্কা করেন, যে হারে কমে গেছে তা অব্যাহত থাকলে সামনে চলতি হিসাবের ভারসাম্য নেতিবাচক হয়ে পড়বে। বিনিয়োগচাহিদা সৃষ্টি হলে বৈদেশিক মজুদের সঠিক সামলা দেয়া সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেন শ্রমিক ফিরে আসছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। যে কারণে ফিরে আসছে তার সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক এর নেতিবাচক প্রভাব যাতে বিদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর না পড়ে তার কোনো যথাযথ কর্মকৌশল এখনো অনুপস্থিত। পাকিস্তান, ইয়েমেন, সুদান, ভারত, নেপাল সহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যেও দেশগুলো থেকে জনশক্তি রফতানি ঠিকই হলে কমছে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতে। অনেকে অনেক টাকা আদম ব্যবসায়ীদের হাতে দিয়েও বিদেশ যেতে পারছন না।