সরকারি গাভী ছুটির দিনে দুধ দেয় না!

SHARE

ekattorস্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি বড় প্রতিষ্ঠান। দেশের সর্বত্র রয়েছে তাদের কর্মকাণ্ড। বাজেটের অঙ্ক বেশ। অফিস ভবন আকারে-সৌন্দর্যে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেবে। তাদের শীর্ষ ব্যক্তির টেলিফোন নম্বর সংগ্রহের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগের সহজ পথ ওয়েব পেজে গেলাম। ফোন নম্বর মিলে গেল সহজে। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও সংযোগ মিলল না। ওয়েব পেজ থেকে ওই অফিসেরই আরেক কর্মকর্তার টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে ফোন দিয়ে জানতে পারি_ তাদের প্রতিষ্ঠান প্রধানের টিঅ্যান্ডটি নম্বর বদলে গেছে।

ওয়েব পেজে কেন রয়ে গেছে আগের নম্বর_ আমার এ প্রশ্নের জবাব অবশ্য মেলেনি। আমি স্বগতোক্তির মতো বলি_ সরকারি অফিস তো!

মিল্ক ভিটা নামের প্রতিষ্ঠানটি অনেক অনেক গ্রাম থেকে দুধ সংগ্রহ করে প্রতিদিন। এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সমবায়ীদের পাশাপাশি সরকারি লোকজনও যুক্ত রয়েছেন। গাভীর শাবক জন্মের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিদিন দুধ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এ দুধ প্যাকেটে ভরে শহরের ক্রেতাদের কাছে পেঁৗছানো হয়। গুঁড়া দুধ হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে। তরল দুধ ক্রেতাদের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন দোকানে। মিল্ক ভিটার সদর দপ্তরেও এ দুধ বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কিংবা অন্যান্য সরকারি দিনে সেখানে দুধ বিক্রির ব্যবস্থা নেই। প্রতিদিন অফিস টাইমের পরও সেখানে মেলে না দুধ। অথচ সাধারণ দোকানগুলোতে আপনি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাবেন প্যাকেটে ভরা দুধ। তারা ব্যবসা বোঝে এবং জানে যে, ক্রেতারা খুব ভোরে কিংবা রাতে অথবা ছুটির দিনে দোকানে আসতে পারে। গাভী ছুটির দিন হিসাব করে দুধ দেয় না। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ দুধ বিক্রির যে আয়োজন সেখানের বিক্রেতারা চলেন অফিস টাইম ধরে।

এক সময় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন বা বিটিএমসির একটি বিক্রয় কেন্দ্র ছিল। সেখানে এ সংস্থার অধীন বিভিন্ন মিলের কাপড় বিক্রি হতো। সেখানেও অফিস টাইম_ বিক্রেতারা যে ‘সরকারি চাকরি’ করেন! একবার প্রবল বর্ষণে ওই বিক্রয় কেন্দ্রের ভেতরে পানি ঢুকে অনেক কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। আগের দামে ওই নষ্ট কাপড় বিক্রির উপায় ছিল না। ব্যক্তিমালিকানাধীন যে কোনো প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ড্যামেজড গুডস কিছুটা লস দিয়ে হলেও দ্রুত বিক্রি করে দেওয়া হতো। মালিক জানেন, যতদিন যাবে লসের পরিমাণ বাড়বে। বিটিএমসির এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম_ আপনারা লস দিয়ে পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়া কাপড় বিক্রি করে দেন না কেন? উত্তরে জানা গেল_ কত ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব চলছে। এজন্য কমিটি করা হয়েছে। তারা রিপোর্ট দিলে উচ্চ পর্যায়ের মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত হবে। আমার প্রশ্ন ছিল_ ততদিনে যে কাপড় পচে যাবে? উত্তর পেলাম_ সরকারি অফিস তো, নিয়ম মেনে চলতে হয়!

আমাদের সব সরকারি অফিসেই ‘অনিয়ম-দুর্নীতি-অবহেলা’_ এভাবে ঢালাও অভিযোগ তোলার যুক্তি নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটানা পাঁচ বছর ধরে স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। এ বছর বই দেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি ছাত্রছাত্রীকে। পাকিস্তান আমল থেকেই এ বই প্রকাশ ও বিতরণের দায়িত্ব ছিল বেসরকারি প্রকাশক ও ব্যবসায়ীদের হাতে। তারা সময়মতো বই প্রকাশ করত না। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা নয়, মুনাফাই ছিল তাদের কাছে মুখ্য। প্রতি বছর এ নিয়ে কতই না খবর থাকত সংবাদপত্রে। এখন সরকার বই প্রকাশ করছে এবং ১ জানুয়ারি নতুন ক্লাস শুরুর দিনে সবার হাতে বই তুলে দিচ্ছে। এ কাজ কিন্তু সুচারুরূপে সম্পন্ন করছে সরকারি দপ্তরের কর্মীরাই। শহর ও গ্রামের হাজার হাজার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বই পেঁৗছে দেওয়ার কাজ যারা সময়মতো করতে পারে, তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে না। কে বলে, সরকার সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে না? কে বলে সরকারি কাজে যুক্তদের দক্ষতা নেই? সরকার পারে_ এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?

কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কেমন যেন চলতে চলতে থেমে থাকার ঘটনা ঘটে। চাকরি যে কেবল চাকরি নয়, সেটা অনেকে ভুলে যায়। সরকারি অফিসার বা কর্মচারী, যে কোনো পদে নিয়োগ পেতে পরীক্ষায় বসতে হয় এবং সেখানে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এ চাকরির শর্ত রয়েছে অনেক। সবচেয়ে বড় শর্ত দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা। আর সেটা পূরণ করতে হলে বুঝতে হবে যে ‘ছুটির দিনেও গাভী দুধ দেয়’।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের ইতিহাসের গৌরবের অধ্যায়ে এক অনন্য স্থান। এখানেই ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দম্ভভরে বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এ বিশাল প্রান্তর সে সময়ে পাকিস্তানের জাতির জনকের ভাষণ শোনার জন্য কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু বাঙালিরা জনসভাস্থলে বসেই জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। তারা দাবি জানায়, বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে।

এই ময়দানেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৫ মার্চ মধ্য রাত থেকে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বাংলাদেশের জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নেয় এবং ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। এই ময়দানেই রচিত হয়েছিল আমাদের দেশের গৌরবের আরেক অধ্যায়। বিশ্বে পরাজিত সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনেক ঘটনা রয়েছে। কিন্তু যে জনগণকে সেনাবাহিনী নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, তাদের সামনে আত্মসমর্পণের দৃষ্টান্ত আর একটিও নেই। এই ময়দানেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছিলেন। এমন একটি ঐতিহাসিক স্থানে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর পেছনে সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। তবে সরকারেরও রাজনীতি থাকে। রাজনৈতিক দর্শন থাকে। প্রায় ১৪ বছর ধরে পরিকল্পনার ফসল আজকের এই জাদুঘর। পাতালে অবস্থিত জাদুঘরটির বিশাল এলাকাজুড়ে ফাঁকা জায়গা। সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের ছবি। জাদুঘরের মাঝখানে রয়েছে একটি ফোয়ারা। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওয়াটার ফল’। ফোয়ারাটি নেমে এসেছে মাটির উপরিভাগ থেকে। ৭ একর বিস্তৃত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৯ বর্গমিটার পাকা চাতাল বা পল্গাজা এবং এর চারপাশে রয়েছে তিনটি জলাশয়, বাঙালি জাতিসত্তার অমরতার প্রতীক ‘শিখা চিরন্তন’ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভিত্তি করে নির্মিত একটি দেয়ালচিত্র। জাদুঘরের উপরিভাগে রয়েছে ১৫৫ আসনসংখ্যার আধুনিক মানের মিলনায়তন।

এ উদ্যোগ যে সময়মতো বাস্তবায়িত হয়নি তার কারণ ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর গঠিত বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সরকারের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন। তারা এ প্রকল্পের কাজ স্থগিত ঘোষণা করেছিল। তাদের কারও কারও কাছে ‘১৯৭১ সাল’ বাঙালির জীবনে নিতান্তই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ কেবলই ‘গোলমাল’। জামাায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে। কেবল বাঙালি_ এ অপরাধেও মানুষ হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সাহস ও বীরত্বগাথা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের বর্বরতার কথা সবার সামনে তুলে ধরার যে কোনো আয়োজনের তারা বিরোধী। আর এ কারণে স্বাধীনতার জাদুঘর বছরের পর বছর পাতালপুরীতে ঘুমিয়ে ছিল। এবারের স্বাধীনতা দিবসে তাকেই জাগিয়ে তুলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। এ স্থানে বাংলাদেশের নানা বয়সের নারী-পুরুষ ভিড় জমাবেন প্রতিদিন, এটাই স্বাভাবিক। তারা যাতে সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যানে সহজে আসতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আসবেন, যারা ১৯৭১ সালে লড়েছেন জীবনবাজি রেখে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। সে সময়ে যারা লড়েছেন, অনেকেই বেঁচে নেই। অনেকে স্বাভাবিক চলাচল করতে পারেন না। তাদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা চাই। আর বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য। তাদের বেশি বেশি করে নিয়ে আসতে হবে স্বাধীনতা স্তম্ভের পাদদেশের এ অনন্য সুন্দর স্থাপনাস্থলে। এ স্থানটি সরকারি তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও হতে হবে একাত্তরের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু যাদের ওপর এ মহান দায়িত্ব রয়েছে তারা কি এ বিষয়টি উপলব্ধি করেন? শুক্রবার বিভিন্ন সংবাদপত্রের একটি খবর দেখে এ নিয়ে সংশয় জাগবেই। এতে বলা হয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতা জাদুঘর পরিচালিত হবে। রক্ষণাবেক্ষণ করবে গণপূর্ত বিভাগ। একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে জাদুঘরের দরজা। প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। ১২ বছরের কম বয়সীদের জন্য লাগবে দুই টাকা। সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার। সরকারি ছুটির দিনগুলোতে জাদুঘরটি বন্ধ থাকবে।

দেখুন, একেবারে অফিস টাইম! মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরে সরকারি ছুটির দিনে আসা যাবে না; কারণ সেদিন সরকারি কর্মীদেরও ছুটি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস_ এসব দিনে জনগণের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হতে পারে জাদুঘর। সবচেয়ে বিস্ময়ের যে ঘোষণা একজন আমলা দিয়েছেন সেটা হচ্ছে, প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় জাদুঘরটি বন্ধ করে দেওয়া। এটা ঠিক যে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন চমৎকার আয়োজন বিকেল-সন্ধ্যায় দেখা যাবে না_ সেটা কেমন কথা? সরকার যদি মনে করে যে, তাদের কর্মী নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্ভব নয়, তাহলে এজন্য বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। বেসরকারিভাবেও পরিচালনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে কেবল একটি বিষয়ই মনে রাখা চাই_ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ না করলে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা প্রকৃতই কঠিন এক কাজ। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখেছি, নানা প্রয়োজনে সেখানে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের (যারা বয়সে অবশ্যই প্রবীণ) সঙ্গে অনেক সরকারি কর্মকর্তা যথাযথ ব্যবহার করেন না। স্বাধীনতার জন্য যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন, তারা কি একটু সদয় ব্যবহার পেতে পারে না?

আশা করব যে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এবং গণপূর্ত বিভাগ স্বাধীনতা জাদুঘর পরিচালনার বিষয়ে প্রথাগত সরকারি নিয়মের বাইরে আসতে পারবেন। এমন মহতী আয়োজন কেবল সরকারি নিয়মের রশিতে যেন বাধা না পড়ে।

সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা

ajoydg@gmail.com