পরম শ্রদ্ধা সেই মাকে

SHARE

চঞ্চল চৌধুরী – কখনো আমার কাছে চঞ্চল ভাই, কখনো চঞ্চল দা। এমন সম্বন্ধে তার কোনো আপত্তি থাকে না, নেই অভিযোগও।

১৪ বছর আগে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো চঞ্চল চৌধুরীর মুখোমুখি হয়েছিলাম। বেইলী রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে সেদিন আরণ্যক নাট্যদলের ‘সংক্রান্তি’ নাটকের মঞ্চায়ন হবে। সবাই ব্যস্ত গ্রীণরুমে। বাইরে বসে আমি আর চঞ্চল দা কথা বলছি। কথা হচ্ছে দুজনের। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের মনপুরায় অভিনয়ের কথা আমাকেই প্রথম জানালেন তিনি। অনেক কথা হলো। জানলাম, পাবনার কামারহাট গ্রামে তার জন্ম। ৫ বোন ৩ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তার একটি কাব্যিক নাম আছে ‘সুচিন্তিত চৌধুরী’। বড় বোনের দেবর নামটি রেখেছিলেন। কিন্তু চঞ্চল চৌধুরী নামেই তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। চারুকলার ছাত্র ছিলেন। সেখানে পড়াকালিন ১৯৯৬ সালে আরণ্যক নাট্যদলে যোগ দেন। প্রথমদিকে মঞ্চের পেছনে কাজ করলেও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এক সময় সামনে চলে আসেন।

২০০১ সালে অনার্স পাসের পর ধানমন্ডির সোডা, কোডা ও ইউডাতে চারুকলার বিষয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে চাকরি করা অবস্থায় মাস্টার্স করেন। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের অভিনয়ের জগতে চঞ্চল চৌধুরী একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। হঠাৎ করেই আজকের অবস্থানে চলে আসেননি তিনি। এজন্য শ্রম ও সময় দিতে হয়েছে। চঞ্চল চৌধুরী মতে, ‘একটি স্থানে যাওয়া যতটা কষ্টকর, তার চেয়েও বেশি কষ্ট সে অবস্থানকে ধরে রাখা।’

২০১২ সালে আরেকটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তার। জানিয়েছিলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলেন সেটা নিয়ে তেমন কিছু করতে পারছেন না। এটি তাকে মানসিক পীড়া দেয়। টিভি নাটকের মতো মঞ্চেও সরব চঞ্চল। একবার চে গুয়েভারার জন্মদিনে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় তার জন্য আরণ্যক প্রযোজিত ‘চে’র সাইকেল প্রদর্শনী বাতিল হয়ে যায়। এজন্য ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল তার। নাটকটিতে অনবদ্য অভিনয়ের পাশাপাশি চঞ্চল চৌধুরীর মাউথঅর্গান বাজানো মুগ্ধতা ছড়ায়। সংগীত পরিবেশন থেকে প্রায় সব ধরণের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে সিদ্ধহস্ত তিনি। এগুলো চর্চা ও আর কঠিন অধ্যবসায়ের ফল। এমনি এমনি হয় না। আরণ্যকের আরেক দর্শকনন্দিত নাটক ‘রাঢ়াঙ’। মামুন ভাইয়ের (মামুনুর রশীদ) রচনা ও নির্দেশনায় রাঢ়াঙ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে দর্শকদের দেখেছি টিকেট সংগ্রহের আগে চঞ্চল চৌধুরী অভিনয় করবেন কিনা, সেই খোঁজ নিতে।

আরেকবার তৌকির ভাইয়ের (তৌকির আহমেদ) নক্ষত্র বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি নাটকের শুটিং কাভার করতে গিয়েছিলাম। শীতের রাতে একটি কক্ষে চঞ্চল ভাই আর রওনক হাসান ছিলেন। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চঞ্চল ভাই গুনগুনিয়ে শাহ আব্দুল করিমের একটি গান গাচ্ছিলেন। আমিও তার সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়েছিলাম। পরে তার অনুরোধে গানটি আমাকেই শেষ করতে হয়েছিল। গান শেষে চঞ্চল দার মন্তব্য ছিল, নো দাই সেলফ। বললেন, ‘তুমিতো এখানে এসেছো আমার সাক্ষাৎকার নিতে। গানের চর্চা চালিয়ে যাও। তোমার ইন্টারভিউও অন্যরা নেবে!’ খুবই উত্তেজিত হয়েছিলাম চঞ্চল ভাইয়ের মুখে সেই মন্তব্য শুনে। সেই নাটকের শুটিংয়ের সময় তার গায়ের জ্যাকেটটি খুলে তিনি আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি চঞ্চল ভাই মা দিবসে তার মায়ের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করেন। পরবর্তি সময় সেই ছবিকে উদ্দেশ্য করে কিছু অর্বাচীনের মন্তব্য মা দিবসের আনন্দটুকু ম্লান করে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়ার ঘৃণ্য অপচেষ্টা করেছে এক শ্রেণির নেটিজেনরা।

আমার কাছে পৃথিবীর সব মায়ের চেহারাই এক। তাদের বড় পরিচয় তারা ‘মা’। সিঁথিতে সিঁদুর কিংবা মাথায় ঘোমটা কোনো বিষয় নয়; যার যার ধর্মীয় রীতি মেনে তিনি সেটি করতেই পারেন। নিজের মা আর চঞ্চল দার মা সব মা’ই আমার কাছে সমান। সেই হিসেবে চঞ্চল দা’ও আমার ভাই বা দাদার মতো। তাছাড়া, মঞ্চ কিংবা গণমাধ্যমে সবার পরিচয় ভাই ভাই।

সুতরাং, কর্মকে আড়াল করে বিভেদের দেয়াল তুলে যারা ধর্মকে সামনে আনার অপচেষ্টা করছেন তারা বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত অসম্প্রদিক চেতনার ঐতিহ্যকে আঘাত করতে অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন। তাদের জন্য করুণা হয়! শুধু অভিনয়েই নয় চঞ্চল চৌধুরী যে বড় মনেরও মানুষ তার আরেকটি প্রমাণ হলো, একজন মহৎ শিল্পী হিসেবে তিনি প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। নিজের ফেইসবুক পেইজে ‘ধর্ম’ শিরোনামে নিজের লেখা একটি কবিতা তিনি আবৃত্তি করে প্রকাশ করেন। সা¤প্রতিক সময়ের নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি কবিতাটি লিখেন।

কবিতার ছন্দে ছন্দে মানবতার মন্ত্র তুলে ধরে চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, মানুষ নিয়ে নয়/ এমনি করে সভ্যতা শেষ, হচ্ছো তুমি ক্ষয়/ধর্ম রক্ষের ঝাণ্ডা তোমায় কে দিয়েছে ভাই/ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করো, জ্ঞান কী তোমার নাই?/ সব ধর্মই এক কথা কয়, মানুষ সেবা করো/ধর্মের নামে ব্যবসা করে ভাবছো তুমি বড়ৃ।’

আবার কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্যকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেন, ‘‘আমি হিন্দু নাকি মুসলিম, তাতে আপনাদের লাভ বা ক্ষতি কি? সকলেরই সবচেয়ে বড় পরিচয় ‘মানুষ’। ধর্ম নিয়ে এসকল রুচিহীন প্রশ্ন ও বিব্রতকর আলোচনা সকল ক্ষেত্রে বন্ধ হোক। আসুন, সবাই মানুষ হই।”

ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা কখন যে কার ওপর কী কথা ছুঁড়ে দেবে তা সত্যিই আশঙ্কার বিষয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তারকারা পর্যন্ত ছাড় পায় না তাদের রোষানল থেকে। মুসলিম হয়েও ২০১৭ সালে এমনি এক সাইবার আক্রমণের শিকার হন ভারতীয় ক্রিকেটার মোহাম্মদ কাইফ। ছেলের সঙ্গে দাবা খেলার ছবি পোস্ট করেছিলেন ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে। ছবির ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি।’ সেজন্য কট্টরপন্থীদের রক্তচক্ষুর সামনে পড়তে হয় তাকে। ধর্মীয় মৌলবাদীদের খপ্পরে শুধু কাইফই পড়েননি; এক সময়ের তারকা পেসার মোহাম্মদ শামি থেকে ইরফান পাঠান সবাই এসব কট্টরপন্থীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। মেয়ের জন্মদিনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করায় সমালোচিত হন শামি। একইভাবে, হিজাব পরিহিত স্ত্রী মুখ না ঢাকা দেয়ায় এবং হাতের আঙুলে নেলপোলিশ থাকায় রোষের মুখে পড়েন পাঠান। কট্টপন্থীরা আসলে এমনই হয়। বাড়াবাড়িটাই তাদের প্রধান ও একমাত্র অস্ত্র।

‘রূপকথার গল্প’, ‘মনপুরা’, ‘মনের মানুষ’, ‘আয়নাবাজি’, ‘দেবী’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী। জন্ম স্বার্থক হয় যদি তার কর্মটা ভালো হয়। তখন সামনে চলে আসে বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ। এমন সন্তানকে জন্ম দিয়ে তাকে লালন-পালন করে যোগ্য করে গড়ে তোলেন যে মা তিনিইতো রতœগর্ভা! পরম শ্রদ্ধা সেই মাকে।