বাংলাদেশে গরু পাচার চক্রের সাথে বিএসএফের যোগসাজশ ফাঁস সিবিআই তদন্তে

SHARE

ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচারকারী চক্রের সঙ্গে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই -এর তদন্তে। ওই পাচার চক্রে বিএসএফ বাহিনীর বেশ কয়েকজন পদস্থ প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, কাস্টমস ও পুলিশের একাংশের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

গরু পাচার চক্রটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদা দিয়ে চালানো হলেও কলকাতায় বিএসএফের কয়েকজন প্রাক্তন কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তদন্তকারীরা।

কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআইয়ের দেশব্যাপী তল্লাশি অভিযান দিয়ে ২৩শে সেপ্টেম্বর গরু পাচার চক্রের সঙ্গে বিএসএফ অফিসারদের যোগসাজশের যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, তা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে।

আবার পাচারের সময়ে যেসব গরু ধরা পড়ত, সেগুলোকে কখনও বাছুর বলে দেখিয়ে বা কখনও পশ্চিমবঙ্গের গরু বলে দেখানো হত – যার দাম পশ্চিম ভারতের গরুর থেকে বহুগুণ কম। ধরাপড়া গরু আবার কাস্টমসের মাধ্যমে নিলাম করা হত যেগুলো কম দামে কিনে নিতো পাচারকারীরাই বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।

একদিকে যেমন পাচার চক্রের মাথা বলে পরিচিত এনামুল শেখের বিপুল সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা, অন্যদিকে বিএসএফের যে কমান্ডান্টের বেশ কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে, তারও বিপুল সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে।

২০১৮ সালে কেরালায় বিএসএফের একজন কমান্ডান্ট নগদে প্রায় ৪৭ লক্ষ টাকা সহ ধরা পড়ার পরেই ওই চক্রটির কথা সামনে আসে। তখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এনামুল শেখও। যদিও এখন তিনি জামিনে আছেন।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন এরা চুনোপুটি। এই গরু পাচার চক্রের পিছনে বিএসএসফ-এর আরও কয়েকজন সিনিয়ার অফিসার জড়িত ছিলেন। এদের কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন, কেউ অন্য নিরাপত্তা বাহিনীতে আছেন।

তদন্তকারীরা বলছেন শুধু বিএসএফ নয়, পাচার চক্রে জড়িয়ে ছিলেন কাস্টমস, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতারাও।

ভারতের গরু পাচার চক্রের শেকড় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত

দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর খবরাখবর দীর্ঘদিন ধরেই রাখছেন দিল্লির প্রবীণ সাংবাদিক চন্দন নন্দী। তিনি বলেন, পাচার চক্রের শিকড় বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

তাঁর ভাষ্য, ‘অত্যন্ত সুসংগঠিত একটা চক্র চলছিল। এর পেছনে রাজনৈতিক হাতও ছিল। শুধু যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু নেতা জড়িত ছিলেন তা নয়। কেন্দ্রের নেতাদের পরিবারও এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকদূর পর্যন্ত জাল বিস্তৃত ছিল এই চক্রটার।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএফ কর্মকর্তারা বলছেন এই পাচার চক্রটা কাজ শুরু করেছিল ২০১৫ সালে। আর ২০১৮ সালে কেরালায় বাহিনীর এক কমান্ডান্ট ধরা পড়ার পরে চক্রটির ব্যাপারে জানা যায়।

গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালেই বাহিনীর এক অফিসার বিএসএফের মহাপরিচালককে চিঠি লিখে এই পাচার চক্র সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা যে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, সেটাও জানিয়েছিলেন তিনি।

ওই চিঠিটিতে লেখা হয়েছিল: “ফারাক্কায় অবস্থিত ২০ নম্বর ব্যাটালিয়নের অফিসারদের কলকাতায় দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তের সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে যাতে পাচারকারীদের কথা শুনে চলা হয়। চোরাচালান করতে দিতে নির্দেশ আসছে। আবার বাহিনী সরিয়ে নিয়ে পাচারের কাজে সুবিধা করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

সীমান্তে অবস্থিত অফিসারাও যেমন ছিলেন ওই চক্রে, তেমনই এমন বেশ কয়েকজন জড়িত থাকার কথা জানা যাচ্ছে, যাদের দায়িত্বে ছিল ভিজিল্যান্স, অর্থাৎ কর্মীরা কেউ ঘুষ নিচ্ছেন কি না, তার ওপরে নজর রাখা।

‘বিএসএফ কর্মকর্তারা গরু পাচার চক্রে জড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’

বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল সমীর কুমার মিত্র বলেন, পদস্থ কর্মকর্তারা গরু পাচার চক্রে জড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

তিনি বলেন, “রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে তখন আর সুরক্ষা বলে কিছু থাকে না। যে বাহিনী জন্মলগ্ন থেকে দেশের জন্য আর বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছে, বিশ্বের বৃহত্তম সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, তার কিছু অফিসার পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন, এটা অকল্পনীয়। বিএসএফের জন্য কলঙ্কজনক একটা ঘটনা।”

তিনি আরও বলছিলেন, “যেভাবে গরু পাচারের গোটা প্রক্রিয়াটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, এটাই বেশি চিন্তার। কিন্তু আমি বলব বিএসএফ তো শুধু সীমান্তে বলবৎ থাকে। পশ্চিম ভারত থেকে বেশ কয়েকটা রাজ্য পেরিয়ে যে গরুগুলো আসছে, সেটা সেখানকার পুলিশ বা শুল্ক বিভাগ কেন আটকাচ্ছে না।”

যে তিন বছর পাচার চক্রটি কাজ করেছে, তার মধ্যেই কোনও সিনিয়ার অফিসার প্রায় ২০০ কোটি টাকা, কেউ ৩০০ কোটি টাকা রোজগার করেছেন চক্রের মাধ্যমে – এমনটাই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তারা কে কোথায় জমি-বাড়ি বা সম্পত্তি কিনেছেন, সেই তথ্যও যোগাড় করেছেন তদন্তকারীরা।

এছাড়াও পাচারের রোজগারের ভাগ নিয়মিত গেছে কাস্টমস, পুলিশের একাংশ আর রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এবং মূলত মুর্শিদাবাদ আর কলকাতা থেকেই চক্রটি কাজ চালাত বলে বিএসএফ-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা যাচ্ছে গরু প্রতি প্রায় ৪০ হাজার টাকা করে লাভ ঘরে তুলত পাচারচক্র। যে প্রাথমিক হিসাব তদন্তকারীরা করেছেন, তাতে শুধু দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চল দিয়েই প্রতিরাতে ১৩-১৪ কোটি টাকা মূল্যের গরু পাচার চলত বছর তিনেক ধরে।

ঘটনাচক্রে ২০১৮ সালে একজন কমান্ডান্ট এবং পাচার চক্রের মাথা ধরা পড়ার পরে কয়েকজন অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া হয় আর তারপরেই সীমান্তে গরু পাচার অনেকটা কমে যায়।

সমীর কুমার মিত্র বলছিলেন সীমান্তের দায়িত্বে বিএসএফ আছে ঠিকই, কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি কর্মচারী নন এমন ব্যক্তিদের নামও হয়ত তদন্তে উঠে আসতে পারে।

তিনি বলেন, “সরকারি কর্মচারী বলে বিএসএফের অফিসারদের নাম উঠে এসেছে প্রথমে। কিন্তু যদি নিরপেক্ষভাবে এবং যথার্থ তদন্ত হয়, তাহলে এমন ব্যক্তিদের নামও বেরিয়ে আসতে পারে, যারা সরকারি কর্মী নন।”

পাচার চক্র যেভাবে কাজ চালাত, তারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে তদন্তের প্রাথমিক স্তরেই। উত্তর বা পশ্চিম ভারত থেকে গরু এনে প্রথমে বীরভূমের একটি জায়গায় রাখা হতো। সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হতো গরুগুলিকে। বি এস এফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আগে থেকেই ঠিক করা থাকত যে কোন জায়গা দিয়ে কত গরু পাচার হবে। নিখুঁত হিসাব রাখা হতো প্রতিটা গরুর। সূত্র : বিবিসি বাংলা।