দেখলেই গুলি?

SHARE
forhadএরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম, ‘এরশাদ তোমাকে দেখামাত্রই গুলি করবে’। সে রকম একটা নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেই সময়। তখনই বুঝেছিলাম এটা মারণকামড়ের মতো। সামরিক শাসকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া স্রেফ অল্প কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তা-ই ঘটেছে। গতকাল দেখছি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি বোমা ফাটায়, তাহলে পাঁচজন লোক নিহত হতে পারে। এ দৃশ্য কোনো বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ওই বোমা বহনকারীকে ক্যাজুয়ালটি (হতাহত) করা তার দায়িত্ব।’ (দেখুন প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫)।
না, এটা তাঁর দায়িত্ব না। তাঁর দায়িত্ব সীমান্ত রা করা। ভারতীয় সীমান্তরী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুলি করে হত্যার হাত থেকে বাঁচানো। কে বোমা হাতে চলাফেরা করছে, কিম্বা কে বোমাসদৃশ কিছু ফাটাবে সেটা তিনি আগাম জানতে পারবেন না, সেটা সম্ভব নয়। তার মানে তিনি বলছেন, কেউ বোমা ফাটাবে এমন সন্দেহ হলে তিনি গুলি করবেন। অথচ স্বীকার করছেন, ‘বিজিবির সবই লিথ্যাল (প্রাণঘাতী) অস্ত্র। বিজিবির সদস্যরা কাউকে গুলি করবে না। তবে কেউ আক্রমণ করলে জীবন বাঁচাতে গুলি করতে পারে।’ যদি বিজিবি গুলি না করে, তাহলে এইসব বলার কী দরকার! আক্রমণ করলে আত্মরার জন্য গুলি চালানো আর আগেভাগে কাউকে বোমা বহনকারী সন্দেহ করে গুলি করার মধ্যে ফারাক আছে। মানবাধিকার কর্মী হিসাবে আমি বিজিবির মহাপরিচালকের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করি। এটা তার এখতিয়ারবহির্ভূত মন্তব্য। এটা বলার কোন আইনি বা সাংবিধানিক অধিকার তার নাই। আশা করি তিনি এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেবেন। বাংলাদেশ সামরিক শাসনের অধীনে নয়, কিম্বা শেখ হাসিনা জরুরি অবস্থা জারি করেছেন বলেও আমরা শুনি নাই। আইনের অধীনে থেকে নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার রা করাই আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্তব্য। বিজিবির অস্ত্র প্রাণঘাতী জেনেও তা নাগরিকদের ওপর ব্যবহারের চিন্তাটাই বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। নাগরিকদের হত্যা তো দূরের কথা।
শুনবার পর থেকেই মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের বক্তব্য নিয়ে ভাবছিলাম। দেখামাত্রই গুলির কথাবার্তা আমার কাছে মারণকামড়ের লণ বলেই মনে হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনী তো অকাতরে আইনবহির্ভূত ভাবে গুলি করছে, এটা আবার সাংবাদিক সম্মেলনে বলবার দরকার কি? এর উত্তর আছে দৈনিক যুগান্তরের খবরে। ‘কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্পর্শকাতর ও জনবহুল স্থানে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ককটেল, বিস্ফোরণ, গুলি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা’ (দেখুন, ‘অপরাধী কারা?’ ১৬ জানুয়ারি ২০১৫)। যে ভাষাতেই খবরটি পরিবেশিত হোক সারকথা হোল, অবরোধ কর্মসূচি চলছে, চলবে এবং তার মাত্রা বাড়তে থাকবে, কমবে না। একে এখন হুমকি দিয়ে থামিয়ে দেবার জন্যই দেখামাত্র গুলির কথা বললেন বিজিবির মহাপরিচালক।
তাঁর কথাকে আমি ক্ষমতাসীনদের সম্ভাব্য পতনের অগ্রিম আলামত হিসাবে নির্ণয় করেছি। তবে আমার বিচারে এটা তিন নম্বর লণ। কবিতা না লিখে আলামতগুলো বোঝাবার জন্যই এই কলামটি পাঠকদের দরবারে পেশ করছি।

ডিজিটাল টেকনলজি ও ডিজিটাল বাংলাদেশের রমরমা সময়েও বাস্তবে কি ঘটছে সেটা জানা বেশ কঠিন। মাঠের খবর জানতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অথচ মাঠের খবরের ওপর এখন নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামি রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশ ছোট দেশ। কঠিন হলেও কি ঘটছে জানতে চাইলে জানা কঠিন নয়। এটা পরিষ্কার যে উত্থানপতন সত্ত্বেও বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি সফল। সেটা একান্তই তৃণমূলের কর্মীদের জন্য। দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদের নির্বিচারে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাঠের ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিকে কিভাবে আগামি দিনে প্রভাবিত করতে পারে সেটা সকলের কাছে স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ গণমাধ্যম তাদের ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। সেই ভূমিকা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট সরকার-বিরোধী আন্দোলন স্তব্ধ করে দেবার জন্য ক্রমাগত প্রপাগান্ডা চালানো। এতে আসল খবর জেনে বাস্তবোচিত বিশ্লেষণ সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্যও। সাধারণ মানুষ, যারা সরকারের পে নন কিন্তু সরাসরি আন্দোলন সংগ্রামেও নাই, তারা কিছুটা বিভ্রান্ত বটে। সরকার ক্রমে সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে এই প্রপাগান্ডায় অনেকের মনে একটি দ্বিধান্বিত প্রশ্ন আছে যে, এই সরকারের পতন ঘটবে কি? উত্তর : অবশ্যই। সেটা আসন্নই বলা যায়। পতনের প্রশ্ন বিতর্কিত নয়, বিতর্কের জায়গা হোল, পতনের চরিত্র কি রূপ নেবে? সেটা কি একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের, নাকি শুধু হস্তান্তর? এটা এখন জাতীয় নেতানেত্রীদের ওপর পুরাপুরি নির্ভর করবে না। নির্ভর করবে যারা মাঠে আন্দোলন করছেন তারা তাদের সংগ্রামের পরিণতি কিভাবে দেখতে চান তার ওপর। অর্থাৎ নির্ভর করবে তৃণমূলের ওপর।

বলা বাহুল্য ক্ষমতাসীনদের বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৈধ মনে করে না। বল প্রয়োগ ছাড়া সরকারের কোনো নৈতিক ভিত্তি আছে সেটাও অধিকাংশ মানুষ মনে করে না। এ পরিস্থিতি থেকে নিস্তারই মানুষের এখনকার প্রধান প্রত্যাশা। সে প্রত্যাশা মিটবে, দ্রুত, এতে কোনই সন্দেহ নাই। নৈতিক ভাবে অন্যায্য, সাংবিধানিক ভাবে অবৈধ ও নিরন্তর নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার লংঘনকারী কোন সরকারের পইে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। এটা স্রেফ কাণ্ডজ্ঞানেই বলা যায়। তুলনায় সামরিক শাসন কিম্বা সংবিধানবহির্ভূত একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা টিকে থাকতে পারে, কারণ মানবাধিকার বা সাংবিধানিক বিধিবিধানের প্রতি তার কোনো দায় থাকে না। সেই ক্ষেত্রে বল প্রয়োগই ক্ষমতার ভিত্তি। ক্ষমতার চরিত্র তখন স্ববিরোধী নয়। কিন্তু সংবিধান ও গণতন্ত্রের নাম করে ক্ষমতা দখল করে রাখা কঠিন ব্যাপার। ক্ষমতা তখন অস্থির ও নিরন্তর অস্বস্তিতে ভোগে। এই ধরনের ক্ষমতা গত বছর ৫ জানুয়ারির পর এত দিন টিকে থাকার কথা ছিল না। বিরোধী দল অকস্মাৎ আন্দোলনে বিরতি দিয়ে ক্ষমতাসীনদের জীবৎকাল দীর্ঘ করেছে। এবার যখন খালেদা জিয়া নতুন করে আন্দোলনে নেমেছেন, বোঝা যাচ্ছে, তিনি পুরোপুরি তৃণমূলের নেতা ও কর্মীদের ওপর নির্ভর করে এই বিপজ্জনক কৌশল গ্রহণ করেছেন। তাঁর দিক থেকে এটা শেষ প্রতিরোধ। এর জয়-পরাজয়ের ওপর তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই কর্মসূচি থেকে তাঁর এখন আর পিছু ফিরে আসার কোনো সুযোগ নাই। অবরোধের কর্মসূচির ডাক দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে থাকাই তাঁর সাময়িক নিয়তি। তাঁর ভাগ্য তৃণমূলের কর্মীদের ওপর নির্ভর করছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এখন বাস্তবে- অর্থাৎ অবরোধ কর্মসূচি শুরু হবার পর কি এমন ঘটনা মাঠে ঘটল যাতে ক্ষমতাসীনদের পতন আসন্ন হয়ে উঠতে পারে? কি আলামত দেখছি যাতে আমরা অনুমান করি যে বিদ্যমান পরিস্থিতি বদলে যাতে পারে?

ঘটনা আসলে আগেই ঘটেছে। ক্ষমতাসীনরা দাবি করছিল গণতন্ত্রের কী দরকার? এখন দরকার উন্নয়ন। নির্বাচন একটা হয়েছে পাঁচ বছর পর আবার দেখা যাবে। বিরোধী দল আন্দোলনে হঠাৎ ক্ষান্তি দেওয়ায় এই আওয়ামী থিসিস বল পেয়ে যায়। দ্রুত একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন না করলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ যে কথা বলে আসছিল, তা মিথ্যা হয়ে গিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া সাত দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে এলেন। তিনি নির্বাচনের কোন নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দিলেন না। কার্যত কিছুই প্রায় বললেন না। মাহমুদুর রহমানকে অন্যায় ভাবে বন্দী করে রাখার দাবিসহ তিনি শুধু সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের কথাই বললেন। দেখা গেল শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত অতি নিরীহ সাত দফা দাবি মেনে একটা সংলাপ বা সমঝোতার কোনো উদ্যোগই নিলেন না। বরং বিএনপিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করবার নীতিতেই অবিচল থাকলেন। খালেদা জিয়া মামলায় হাজির হবার জন্য আদালতে গিয়েছিলেন। সেখানে সশস্ত্র ভাবে লীগ-সমর্থকদের লেলিয়ে দেওয়া হোল। খালেদা ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করবেন বলে একটি সমাবেশ করতে চাইলেন। তাঁর কার্যালয় বালুর ট্রাক ও পুলিশের গাড়ি দিয়ে ঘেরাও রাখা হোল। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের মহিলা সদস্যদের চোখে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই কোন প্রকার উসকানি ছাড়া মরিচের গুঁড়া ছুড়ে মারা হোল। পুলিশের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেও ক্ষমতাসীনরা স্বস্তি পাচ্ছিল না। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের যারপরনাই ভীতি ও অস্থিরতা দেখে বোঝা যায় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার কোনো নৈতিক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আর নাই। খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে তালা লাগাবার মধ্য দিয়েই ক্ষমতাসীনরা তাদের য়ের খবর ঘোষণা করে দিয়েছেন। যারা তালা মেরেছে ক্ষমতা থেকে তাদের পতন ছাড়া তালা খুলবার চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই সত্য ফর্সা হয়ে উঠেছে।

দুই
না। আমি গণক নই, এটা গণকদারি নয়। বাস্তবতার বিচার। ক্ষমতাসীনদের সম্ভাব্য পতনের প্রথম আলামত হচ্ছে সাধারণ মানুষের দোদুল্যমানতা সত্ত্বেও অবরোধ কর্মসূচির অভাবিত সাফল্য। দমন-পীড়নের মুখে অবরোধ ধীরে ধীরে স্তিমিত না হয়ে বরং আরো জোরদার হচ্ছে। ঢাকা শহরে থেকে যা বুঝে ওঠা কঠিন। সরকারকে বিজিবি মোতায়েন করতে হয়েছে, বেসরকারি প্রশাসন আর সামাল দিতে পারছে না।

দ্বিতীয় আলামত হচ্ছে নতুন করে আরো কঠোর ভাবে দমন-নিপীড়ন শুরু করবার সরকারি সিদ্ধান্ত। দমন-নিপীড়ন হত্যা-গুম নতুন কিছু নয়। কিন্তু অবরোধ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনদের কঠোরতা কর্মসূচিকে আরো বেগবান করবে। নতুন করে কঠোর হওয়া ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পরাজয় ও নৈতিক দুর্বলতার লণ। এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ নিয়োগ এবং যৌথ বাহিনীর অপারেশান চালিয়ে বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, হত্যা ও গ্রেফতার রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গুম, গুমখুন, হত্যা ও নির্যাতন নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাসীনদের মানবাধিকার লংঘনের মাত্রা অতীতের যেকোন রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। আন্দোলনে সহিংসতা কেউই চায় না, কিন্তু ক্ষমতাসীনরা নিজেই যেখানে আইনি বিধিবিধান মানে না, নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করে না, সেখানে বিরোধী পরে আন্দোলন সহিংস ও বেআইনি হতে বাধ্য। যদি সাংবিধানিক বিধিবিধান শুধু বিরোধী দলেরই মান্য, ক্ষমতাসীনদের মান্য নয়, তাহলে সে ক্ষমতা সাংববিধানিক নয়। পাল্টা বলপ্রয়োগ ছাড়া তার অন্য কোন মীমাংসা নাই। বাংলাদেশে তা-ই ঘটছে। নীতিবাগিশরা বিস্তর হিতোপদেশ দিচ্ছেন দেখতে পাই। ক্ষমতাসীনদের যদি আইন ও সংবিধান মেনে চলতে আমওরা বাধ্য করতে না পারি তাহলে বিরোধী পকে এই ক্ষেত্রে হিতোপদেশ দিয়ে লাভ নাই। অবরোধ ও আন্দোলন জেলজুলুম দিয়েও দমানো যাবে না, বরং তা বাড়বে।

সরকার অসাংবিধানিক ও বেআইনি কাজ করলেও প্রশাসনের একাংশ সরকারকে মদদ দিয়ে পরিস্থিতিকে আরো সহিংস করে তুলছেন। প্রশাসনকে বুঝতে হবে, ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রা করতে গিয়ে তারা আইনবহির্ভূত কাজ করতে পারেন না। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে তাকে তালাবদ্ধ করে রাখবার এখতিয়ার তাদের নাই। আশা করি, এই ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লিখিত নির্দেশ তাদের কাছে আছে, যাতে তারা আগামিতে নিজের সাফাই কিছুটা হলেও গাইতে পারেন। আইনশৃংখলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের আইনবহির্ভূত ভাবে হত্যা করতে পারে না। মনে রাখা দরকার শেখ হাসিনা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য কোনো দায়মুক্তির বিধান করেন নি, করলেও সেটা আইনে টিকবে না। ফলে পুলিশ ও প্রশাসন যা কিছুই করছে তার দায় ক্ষমতাসীনদের পতন হলে তাদের ঘাড়ে এসে পড়বে। এর জন্য তাঁরা তৈরি কি না কে জানে। আমার ধারণা শেখ হাসিনা দায়মুক্তির বিধান না করার মানে পুলিশ, র‌্যাব ও প্রশাসনের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করল ক্ষমতাসীনরা প্রশাসনকে আগের মতো জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করতে পারেন, কিন্তু তাঁকে কেউই ক্ষমতা দেয় নি যাতে বেগম জিয়াকে বলতে পারেন তিনি বাড়ি যেতে চাইলে যেতে দেওয়া হবে, কিন্তু অন্য কোথাও নয়। একজন স্বাধীন নাগরিক, তিনি যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারেন। নাগরিক আইনের অধীন, কিন্তু কারো হুকুমের চাকর নন। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। তাহলে প্রশাসনকেই দায় নিতে হবে।
ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়নের মুখে মার খেয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সাময়িক চুপ থাকতে পারে, কিন্তু শক্তি সঞ্চয় করে তারা আবার ফিরে আসবে। সেটাই ঘটছে এবার। এটা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের সম্ভাব্য পতনের তৃতীয় আলামত। তারা পারছে কারণ জনসমর্থন তাদের বিরুদ্ধে নয়, ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে সরকার ও প্রশাসন যেখানে সহিংস ও সন্ত্রাসী সেই ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের নিয়ক্ষমতান্ত্রিকতা বা আইনের বিধান মেনে চলার কথা বলা হাস্যকর। গাড়ি পোড়ানো ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করার নজির খুবই নিন্দনীয় কাজ। অতীতে এ কাজ আওয়ামী লীগ করেছে, তারাই প্রথম নজির সৃষ্টি করেছিল। তার অনুকরণ নিন্দনীয় কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু বোঝা মুশকিল এটা ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই কুকাণ্ড করে বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে কি না। জনগণ যখন সরকারের ওপর বিশ্বাস হারায়, তখন এভাবেই চিন্তা করে।

গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় যৌথবাহিনীর অভিযানের খবর এসে পৌঁছাচ্ছে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আগে সাতীরায় একই ধরনের অভিযানে ভারতের সীমান্তরী বাহিনীর অংশগ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল। সত্য কি মিথ্যা সেটা ভিন্ন তর্ক। মানুষ বিশ্বাস করেছে। কথা হোল, দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের নিজেদের নাগরিকদের ওপর এই ধরনের যুদ্ধাভিযান চালায়, সেটাই বিস্ময় ও সন্দেহ তৈরি করে।

পত্রিকার রিপোর্ট হচ্ছে, “সকাল থেকে র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর একাধিক দল বিভক্ত হয়ে অভিযান শুরু করে। পুরো উপজেলায় পরিচালিত হয় এ অভিযান। অভিযানে বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশির নামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে কমপে ৩০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাই হয়েছে বাড়ির আসবাবপত্র। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় পুরো এলাকা এখন পুরুষশূন্য। এলাকার সকল দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত এসব এলাকা সন্ত্রাসমুক্ত না হবে ততণ তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে” (দেখুন দৈনিক মানবজমিন ১৬ জানুয়ারি ২০১৫)। অভিযানে ২৫ জামায়াত-বিএনপির কর্মীকে আটক করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মতিউর রহমান (৩০) নামে এক ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছেন। মতিউর রহমান শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি।

এটা সম্ভবত স্পষ্ট যে বিরোধী দলের কর্মসূচি কেবল একটি কারণেই ব্যর্থ হতে পারে, যদি খালেদা জিয়া আন্দোলনে অবিচল না থেকে কোন প্রকার দোদুল্যমানতা প্রদর্শন করেন। আমার অনুমান পিছু হটে আসা তাঁর পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। তাঁকে গ্রেফতার করলেও তিনি তৃণমূলে যে সংবাদ পৌঁছয়ে দেবার, সেটা খানিক পেরেছেন। ফলে তাঁর চার দিকে ঘিরে থাকা জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাঁর কর্মসূচি এর আগে যেভাবে বানচাল করে দিয়েছিল, তিনি অবিচল থাকলে সেটা আর সম্ভব হবে না। আন্দোলনের নেতৃত্ব অপোকৃত তরুণদের হাতে চলে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য তার পরিণতি কী দাঁড়াবে, সেটা বলবার সময় আসে নি। তবে অবরোধ আন্দোলন আরো এক স্তর তীব্র হলে সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।

আপাতত আমরা বোমা হাতে সন্দেহে কাউকে হত্যার চিন্তায় গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। একে ক্ষমতাসীনদের পতনের আওয়াজ গণ্য করলেও এই ধরনের মানবাধিকারবিরোধী চিন্তার নিন্দা জানানো আমাদের কর্তব্য।

ফরহাদ মজহার: কবি, কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল : [email protected]