বড় বাপের পোলায় খায়’ ও পুরান ঢাকার ইফতার ঐতিহ্য

SHARE

boro-baper-polay-khay-online-dhaka-guideইফতার বাজার হিসেবে পুরান ঢাকার চকবাজারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। শাহী ইফতার মানেই পুরান ঢাকার চকবাজারের ইফতার। রমজানের প্রতিদিন দুপুর থেকেই চকবাজার ছাপিয়ে পুরান ঢাকার অলিগলির বাতাসে ভাসে নানা স্বাদের মুখরোচক খাবারের মনকাড়া সুবাস। ইফতার ঐতিহ্যে এবারও জমজমাট পুরান ঢাকা। ঐতিহ্য বজায় রেখে দোকানি আর ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর রমজানে আনছেন নতুন নতুন ইফতার আয়োজন। মূল আয়োজনটা চকবাজারকে ঘিরেই। এই বাজারের ইফতার সামগ্রীর প্রতি সব সময়ই বিশেষ আগ্রহ থাকে রোজাদারদের। এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঐতিহ্যবাহী এ ইফতার নিয়ে যথারীতি এ বছরও জমে উঠেছে পুরান ঢাকার চকবাজার।

‘বড় বাপের পোলায় খায়’
রমজান মাসে চকবাজারে ইফতার কিনতে গেলে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হচ্ছে, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়।’

রকমারি ইফতার বাজারের একটি জনপ্রিয় আইটেম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। ঐতিহ্যবাহী এই পদটি প্রায় ৭৫ বছরের পুরনো বলে জানা যায়।

এটি তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ১৬ ধরনের মসলা প্রয়োজন। আর মোট ৩১টি পদের যে মিশ্রণ তৈরি হয়, তার নামই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’।

একটি বড় গামলায় এই ৩১ ধরনের পদ দুই হাতে ভালোভাবে মাখিয়ে তারপর ঠোঙায় করে বিক্রি করা হয়। এটি কিনতে ছোট-বড় সব বয়সী রোজাদারের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যায়।

কেবল এই আইটেমটির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা ছুটে যান চকবাজারে। এখনো পুরান ঢাকার এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের এটি ছাড়া ইফতার জমে না, পূর্ণতা পায় না। নতুন ঢাকার বাসিন্দারাও দিন দিন এই খাবারটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বর্তমানে মূল্য প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য
শাহী মসজিদের সামনে একটি কূপ ছিল। তার চারপাশেই চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে বিক্রি করা হতো ইফতারের বিভিন্ন উপকরণ। কালের বিবর্তনে পুরান ঢাকার চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার বর্তমান চেহারা পেয়েছে।

তবে ইফতারর বাহারি সমারোহের জন্য চকবাজার যে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে এ নিয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক নেই।

মোগল রসুইখানার খাবারগুলো ঢাকার নবাবদের কল্যাণে আগেই ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে যায়। চকবাজারের কল্যাণেই সেসব খাবারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাধারণ মানুষের। ক্রমেই এগুলো ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘চকবাজারের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, আরব বণিকরা এখানে দাস ব্যবসা করতেন। চক আরবি শব্দ। এর অর্থ ‘নাখাশ’ অর্থাৎ ‘দাস বিক্রেতা’। জনশ্রুতি আছে, মোগল আমলে এখানে দাস-দাসী কেনাবেচা হতো। ১৮৫৭ সালের আগেই চকবাজারের বিখ্যাত ইফতারর বাজার গড়ে ওঠে ।’

নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ‘১৮৫৭ সালের আগেই চকবাজার জমজমাট হয়। সে সময়েই চকবাজারে গড়ে ওঠে নানা রকম মুখরোচক খাবারের দোকান। রোজার সময় মোগলাই খাবার এবং রকমারি ইফতার বিক্রি করা হতো এখানে।’

৭০ বছর বয়সী শরবত ব্যবসায়ী আহমেদ হোসাইন জানান, তার দাদার বাবাও এখানে রোজায় শরবতের ব্যবসা করেছেন। তার হিসাবে, দেড়শ বছর ধরে চকবাজারে ব্যবসা করছে তার পরিবার। একই রকম তথ্য দিলেন চকবাজারের ইফতারর বিক্রেতা আবদুল কাহহার। তিনি জানান, ছয় পুরুষ ধরে বাজারে ইফতারর ব্যবসা তাদের।

চকবাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ৪০০- ৪৫০ টাকা, প্রতি কেজি সুতি কাবাব ৪০০ থেকে ৫০০, শাহী জিলাপি ১২০, খাসির হালিম আকার ধরন ভেদে ৫০ থেকে ৩৫০।

খাসির রোস্ট ১৮০ থেকে ২২০, কোয়েলের রোস্ট ৬০, খাসির কাবাব ৫০ টাকা এবং দই বড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ডিম চপ ১৫, মুরগি ভাজা ১৮০, মুরগির ফ্রাই ৫০, মাঠা ৫০ টাকা লিটার, লাবাং ৮০ টাকা, চিকেন ছাসনি ২০ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হতে দেখা যায়।

চকবাজারে ব্যাপক বিক্রি হচ্ছে মালপোয়া ও গজা। একটি মালপোয়ার দাম ২০ টাকা ও গজা দুটি ২০ টাকা। এ ছাড়া পাওয়া যাচ্ছে সাধারণ ইফতার সামগ্রীও। তবে উপাদান ও তৈরিতে কিছু ভিন্নতা রয়েছে এখানেও।

পাওয়া যাচ্ছে বুটের ডাল ও মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি টিক্কা কাবাব, ডিম চপ ১৫ টাকা, দুই টাকার ফুলুরি, আলুর চপ, পিঁয়াজু ও ১২ টাকার সবজি বড়া।