কারাগারে এক জন্মদিনের কথা

SHARE

আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনো দিন নিজে পালন করিনি—বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয় আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!’ দেখে হাসলাম। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দেবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলে-মেয়েরা ও রেণু আসত ভালোই হতো। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সঙ্গে দেখা করতে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম—আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি সাদা গোলাপ এবং ডিপিআর

বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।

আমি থাকি দেওয়ানি ওয়ার্ডে, আর এঁরা থাকেন পুরনো ২০ সেলে। মাঝেমধ্যে দেখা হয় আমি যখন বেড়াই আর তাঁরা যখন হাঁটাচলা করেন স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য।

খবরের কাগজ পড়া শেষ করতে ৪টা বেজে গেল। ভাবলাম ‘দেখা’ আসতেও পারে। ২৬ সেলে থাকেন সন্তোষ বাবু, ফরিদপুরে বাড়ি। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী দলে ছিলেন, বহুদিন জেলে ছিলেন। এবারের মার্শাল ল জারি হওয়ার পরে জেলে এসেছেন, আট বছর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরে প্রায় ১৭ বছর জেল খেটেছেন। শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল হাসপাতালে প্রায়ই আসেন, আমার সঙ্গে পরিচয় আগে ছিল না। তবে একই জেলে বহুদিন রয়েছি। আমাকে তো জেলে একলাই অনেক দিন থাকতে হয়েছে। আমার কাছে কোনো রাজবন্দিকে দেওয়া হয় না। কারণ ভয় তাদের আমি ‘খারাপ’ করে ফেলব, নতুবা আমাকে ‘খারাপ’ করে ফেলবে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ২৬ সেলে যাবেন। দরজা থেকে আমার কাছে বিদায় নিতে চান। আমি একটু এগিয়ে আদাব করলাম। তখন সাড়ে ৪টা বেজে গেছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলে-মেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায়নি। ৫টাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলে-মেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওনা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বছরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরিয়ে দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলে-মেয়েদের চুমো দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠিয়ে দিয়েছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেলগেটের সবাইকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সঙ্গে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।

আরেকটা কেক পাঠিয়েছে বদরুন, কেকটার ওপর লিখেছে—‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠিয়েছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আমার ছেলে-মেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও।’

৬টা বেজে গেছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলে-মেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নেই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোরবেলা খুলবে।

১৭ মার্চ ১৯৬৭ : শুক্রবার