শান্তির দেশে সন্ত্রাসের থাবা

SHARE

দিনের শুরুটা ছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। সপ্তাহান্তের ছুটির দিনের আগে ক্রাইস্টচার্চের বাসিন্দারা নিচ্ছিলেন ছুটি কাটানোর প্রস্তুতি। কিন্তু দিনের শেষটা হলো রক্তের সোঁদা গন্ধে। শহরে এখন ভয়ের রাজত্ব। রাতটা নিশ্চয়ই নির্ঘুম কাটবে ক্রাইস্টচার্চের, সঙ্গী থাকবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

শান্তির সূচকে বিশ্বজুড়ে সুনাম নিউজিল্যান্ডের। ২০১৮ সালে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে দেশটি। এমন একটি দেশেই শুক্রবার দুপুরে এক মসজিদে হলো নারকীয় সন্ত্রাসী হামলা। নিহতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৪৯, আহত ৪৮। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন অনেকে।

অকস্মাৎ এমন হামলার ঘটনায় নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। আরও বেশি হতবুদ্ধি অবস্থা ক্রাইস্টচার্চের মানুষের। ক্রাইস্টচার্চ সবুজে ঘেরা একটি শহর, গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে ঘরবাড়ি। এমন একটি শান্ত, নিরূপদ্রব শহরে শুক্রবার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে গুলি ছুটেছে। নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ খুঁজতে গেলে ইতিহাসের অনেক পাতা ওল্টাতে হয়, যেতে হয় অনেক পেছনে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দরুন এ ধরনের ব্যাপক প্রাণহানি প্রত্যক্ষ করেছিল দেশটি। এর পর থেকে আর ঘটেনি কখনো। এবার নতুন উদাহরণ সৃষ্টি হলো দেশটিতে, হয়তো তৈরি হলো অনেক আশঙ্কাও।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নিহত লোকজনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি। হামলা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। জাতীয় ক্রিকেটারদের এখন দেশে ফিরিয়ে আনার জোর প্রক্রিয়া চলছে। দলের ম্যানেজার খালেদ মাসুদ জানিয়েছেন, সব ঠিক থাকলে শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে দশটার পর পর দেশে আসবেন।

শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা দেড়টার দিকে ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত মুসলমানদের ওপর প্রথম হামলা চালান এক সন্ত্রাসী। পরে কাছাকাছি শহরতলি লিনউডের মসজিদেও সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। তবে দ্বিতীয় মসজিদে হামলাকারী একই ব্যক্তি কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী কারও কারও মতে, একাধিক সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী রমজান ছিলেন আল নূর মসজিদে। তাঁর জবানিতে, ‘পুরো মসজিদে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা। হঠাৎ করেই শুরু হলো গুলির শব্দ। চোখের সামনে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল জ্যান্ত মানুষগুলো।’

হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এক নারীসহ চারজনকে আটক করেছে নিউজিল্যান্ড পুলিশ। বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে একটি গাড়ি থেকে। হামলাকারী অস্ট্রেলীয় নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হামলার ১৭ মিনিটের একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। বলা হচ্ছে, ব্রেন্টন টারান্ট নামের ওই অস্ট্রেলীয় নাগরিকই আল নূর হাসপাতালে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। অস্ট্রেলীয় সরকার এরই মধ্যে ব্রেন্টনের জাতীয়তা নিশ্চিত করেছে। তবে নিউজিল্যান্ডের পুলিশ বিভাগ অবশ্য এখনো জানায়নি যে, তাঁকেই আটক করা হয়েছে কিনা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সরকার বলছে, তাদের একজন নাগরিককে শুক্রবারের হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নিউজিল্যান্ডের কোথাও কোনো মসজিদে মুসলিমদের যেতে নিষেধ করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে মসজিদগুলো আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ক্রাইস্টচার্চের বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। শহরজুড়ে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। পুরো ক্রাইস্টচার্চ এখন এক অবরুদ্ধ শহর। জরুরি প্রয়োজন কারও বাইরে বের হওয়া মানা।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ্যারডের্ন এ ঘটনার নিন্দা প্রকাশ করে বলেছেন, এ ঘটনা নিউজিল্যান্ডের জন্য ঘোর অমানিশা। জেসিন্ডা অ্যারডের্ন টুইটে বলেছেন, ‘ক্রাইস্টচার্চে নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলার জায়গা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে নিউজিল্যান্ডের অভিবাসী সম্প্রদায়ের। নিউজিল্যান্ডেই তাঁদের বাড়ি। তাঁরা আমাদের লোক।’

একই সুরে নিন্দা প্রকাশ করেছেন বিশ্ব নেতারা। সবাই দৃঢ় কণ্ঠে এই নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন, হতাহতদের পরিবারকে জানিয়েছেন সমবেদনা।

ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে প্রধান আলোচিত খবর ছিল। বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিটিই তাদের অনলাইন সংস্করণে হামলার ঘটনাপ্রবাহের প্রতি মুহূর্তের হালনাগাদ জানিয়েছে। টেলিভিশন ও বেতার চ্যানেলগুলো সংবাদ প্রচার করেছে সারাক্ষণ। তবে হামলার ভিডিও ও হামলাকারীর মৌলবাদী ও বর্ণবিদ্বেষী ইশতেহার প্রচার করায় প্রশ্নও উঠেছে বিস্তর, গণমাধ্যমের সমালোচনাও হচ্ছে।

এখনো পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে বলা যায়—ক্রাইস্টচার্চে উগ্রবাদের বলি হয়েছে ৪৯টি তাজা প্রাণ। উগ্রবাদী তত্ত্বের আড়ালে হয়েছে ঘৃণার চাষ। সেই আবাদে ফুল ফোটে না, কেবল রক্ত ঝরে।