কিউদের বধ করে বাংলাদেশ ছয়ে

SHARE

হামিশ বেনেটের শর্ট বলটিকেই বেছে নিলেন তিনি। দুর্দান্ত পুল শটে মিড উইকেট দিয়ে দুরন্ত এক বাউন্ডারি। মুষ্টি পাকিয়ে শূন্যে ঘুষি মারা মাহমুদউল্লাহ ততক্ষণে সঙ্গী ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমের আলিঙ্গনাবদ্ধ। বাংলাদেশ দলের ডাগআউট থেকে বিজয় উল্লাস ছড়িয়ে পড়তে লাগল ডাবলিনের ক্লনটার্ফ ক্রিকেট ক্লাব গ্রাউন্ডে। লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে নেমে এলেন প্রবাসী বাংলাদেশি দর্শকেরা।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এর আগেও আটটি ওয়ানডে জিতেছে বাংলাদেশ দল। কিন্তু সবই দেশের মাটিতে। দেশের বাইরে তাদের বিপক্ষে জয়ের স্বাদ এই প্রথম। ওয়ালটন ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি তারপরও কিউইদের হাতেই উঠেছে। তবে কালকের ম্যাচটা জিতে বাংলাদেশের প্রাপ্তিও কম নয়।

শ্রীলঙ্কাকে টপকে প্রথমবারের মতো তারা উঠে গেছে আইসিসির ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের ষষ্ঠ স্থানে। ২০১৯ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলা নিয়ে আর কোনো শঙ্কা এখন থাকার কথা নয়।

নিউজিল্যান্ডের ২৭০ রানের জবাব বাংলাদেশ দিতে শুরু করে তামিম ইকবালের দুর্দান্ত এক ছক্কায়। প্রথম ওভারে স্পিনার এনে হয়তো বাংলাদেশের ওপেনারদের চমকেই দিতে চেয়েছিল নিউজিল্যান্ড। জিতান প্যাটেলের করা তৃতীয় বলে সৌম্য সরকারকে ফিরিয়ে কিছুটা সফলও তারা। কিন্তু তার আগেই ওই ছক্কায় কিউইদের পাল্টা চমক দেন তামিম। প্যাটেলের করা ইনিংসের প্রথম বলটাই উড়িয়ে নিয়ে ফেললেন সাইটস্ক্রিনের ওপারে।

তামিমের সেই ঝোড়ো শুরুতে পরে সংগত দেন সাব্বির রহমান। দ্বিতীয় উইকেটে দুজনের ১৩৬ রানের জুটি, দুজনই করেছেন ৬৫ রান করে। তবে জয়ের কাব্যের শেষ অধ্যায়টা রচনা হয়েছে মুশফিকুর রহিম-মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে। ১৯৯ রানে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিব আল হাসানের বিদায়ের পর দুই ভায়রা মিলেই লক্ষ্যে পৌঁছে দেন বাংলাদেশকে। ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এই জয় মাশরাফি বিন মুর্তজার দলকে দেবে বাড়তি আত্মবিশ্বাস।

গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে তীরে এসে তরি ডুবিয়েছিল মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ জুটি। তবে কাল যেন তাঁরা জয় নিয়ে ফেরার পণ করেই বেঁধেছিলেন জুটিটা। সাকিবের আউটের পর জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৭০ বলে ৭২ রান। শুরুটা ধীরস্থিরভাবে করে আস্তে আস্তে দলকে লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যান মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ। শেষ পর্যন্ত জয় এসে যায় ১০ বল বাকি থাকতে।

অথচ তামিম আউট হওয়ার পর যে রকম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল বাংলাদেশ, তাতে একপর্যায়ে জয়ের স্বপ্ন হারিয়েই যেতে বসেছিল। ১৪৩ থেকে ১৬০ রানের মধ্যে বিদায় নেন তামিম, সাব্বির ও মোসাদ্দেক। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু মুশফিক-সাকিবের ৩৯ রানের পঞ্চম উইকেট জুটিতে। বাকিটা মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর লেখা ইতিহাস। ৪৫ বলে অপরাজিত ৪৫ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ মুশফিক। অপরাজিত ৪৬ রানের ইনিংসে মাহমুদউল্লাহ পূর্ণ করেছেন ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর তিন হাজার রান।

বোলিংয়ে বাংলাদেশের শুরু একটু এলোমেলো হলেও সময়ের সঙ্গে সেটিও এসেছে নিয়ন্ত্রণে। লেগ স্টাম্পের বেশ বাইরে করে ইনিংসের প্রথম বলেই মাশরাফি বিন মুর্তজা দিলেন ওয়াইড। পরের বলটাও এলোমেলো। ওয়াইড না হলেও বল অফ স্টাম্পের এতটাই বাইরে দিয়ে গেল যে উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরতে হলো সেটি। অধিনায়ক এরপর নিজেকে ভালোই সামলে নেন। নাসির হোসেন স্কয়ার লেগে সহজ ক্যাচ না ছাড়লে ওই ওভারেরই তৃতীয় বলে পেতে পারতেন কিউই অধিনায়ক টম ল্যাথামের উইকেটটি। তিন ওভারের শেষ স্পেলে ১৫ রান দিয়ে শেষ পর্যন্ত উইকেট পেয়েছেন দুটি।

তিন স্পেলে মাশরাফির ১০ ওভারের বোলিং যেন বাংলাদেশ দলের পুরো বোলিং চিত্রেরই ট্রেলার! শুরুতে কিছুটা বল্গাহীন, শেষ দিকে এসে নিউজিল্যান্ডের টুঁটি চেপে ধরা। নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের দিকে তাকালেই স্পষ্ট সেই দুটি ভাগ। চার উইকেটে ২০৮ রান। পরের চার উইকেটের পতন মাত্র ৫০ রানে। রান ২২৪ থেকে ২২৬-এ যেতেই উইকেট পড়েছে তিনটি। শেষ ১০ ওভারে যোগ হয়েছে মাত্র ৫৩।

নিউজিল্যান্ডের ইনিংসকে ধীরে ধীরে পিরামিডের চূড়ার মতো সরু করে ফেলায় বাংলাদেশের বোলারদের সবারই এক-আধটু কৃতিত্ব আছে। শুরুতে ক্যাচ ফেললেও শেষ পর্যন্ত ল্যাথামের উইকেটটা নিয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা নাসির। নিল ব্রুমকে ফিরিয়ে ল্যাথাম আর তাঁর ১৩৩ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটিটাও তিনিই ভাঙেন। এর আগে ২৩ রানে ওপেনিং জুটি উপড়ে দেন মোস্তাফিজ। আর শেষ দিকে সাকিব-রুবেল-মাশরাফি ত্রিফলা। মাশরাফি, সাকিবের মতো রুবেলের উইকেটও হতে পারত দুটি। কিন্তু শেষ ওভারে রস টেলরের সহজ ক্যাচ ছেড়ে তাঁকে বঞ্চিত করলেন এই ম্যাচেই দুটি ক্যাচ নেওয়া মাহমুদউল্লাহ।

দিন শেষে অবশ্য প্রমাণিত—ক্যাচ মিস মানেই সব সময় ম্যাচ মিস নয়। ক্যাচ ছেড়ে শুরু করা ম্যাচেও ওড়ানো যায় জয়ের পতাকা।