তীরের কাছে ডুবলো তরি

SHARE

ভারতীয় ক্রিকেটারদের লাফালাফি শেষে দুদলের খেলোয়াড়দের হাত মেলানো-টেলানো সারা। প্রায় সবাই বেরিয়ে গেছেন। সাকিব আর তামিম তখনো মাঠের মাঝখানে। সাকিব উত্তেজিতভাবে কিছু একটা যেন বললেন। তারপর দুজনই কোমরে হাত দিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর শরীরটা টানতে টানতে ড্রেসিংরুমে ফেরা।
ফেরার সময় উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা হরভজন সিংয়ের দিকে চোখ পড়ল তামিমের। পিঠে টোকা দিয়ে তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন। হরভজন হাত ছাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন তামিমকে। কিছুক্ষণ ধরেই থাকলেন।
এই ম্যাচে এত সব নাটক ছাপিয়ে ওই দৃশ্যটাই কি শেষ পর্যন্ত অমর ছবি হয়ে গেল! এমন এক ম্যাচ, যাতে আসলে বিজয়ের আনন্দে ভেসে যেতেও বিজয়ীর মনে বিজিতের জন্য একটু কষ্ট ছুঁয়ে যায়!
টি-টোয়েন্টি মানে নাটক। টি-টোয়েন্টি মানে শেষ ওভারের নখ কামড়ানো উত্তেজনা। এই বিশ্বকাপ তো তাহলে টি-টোয়েন্টি নামের ‘কলঙ্ক’! শেষ হওয়ার অনেক আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে ম্যাচের পর ম্যাচ। অবশেষে বেঙ্গালুরুর উন্মাতাল গ্যালারির সামনে টি-টোয়েন্টি দেখা দিল আপন মহিমায়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটা কি আর সেই বৃহত্তর ছবি দেখার ম্যাচ!
এই ম্যাচ হৃদয় ভেঙে দেওয়া এক দুঃখের নাম। হাতের মুঠোয় নিয়েও জয়টাকে ছুড়ে ফেলার ম্যাচ। এমনই অবিশ্বাস্যভাবে যে, দুঃখ শব্দটা এখানে ‘শোক’ হয়ে যেতে চায়। ২০১২ এশিয়া কাপের সেই ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হারার পর মাঠেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মুশফিক-সাকিবরা। কাল কান্নাকাটি কিছু হয়ে থাকলে তা আড়ালেই হলো। সেই কান্না পিছু তাড়া করার কথা অনেক দিন। মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর শয়নে-স্বপনে নিশ্চিতভাবেই ফিরে ফিরে আসবে শেষ তিন বলের ওই দুঃস্বপ্ন।
শেষ ওভারে ১১ রান চাই। প্রথম তিন বলেই হয়ে গেল ৯। শেষ তিন বলে ২ রান, বাকি সব সমীকরণ মুছে দিয়ে ম্যাচ তখন একটা সম্ভাবনা নিয়েই দাঁড়িয়ে—বাংলাদেশই জিতছে। হার্দিক পান্ডিয়াকে পরপর দুটি চার মেরে সেই জয়ের আগাম উল্লাসটাও যেন করে ফেললেন মুশফিকুর রহিম!
তাতেই কি সর্বনাশটা হলো! আবেগের ঢেউ এলোমেলো করে দিল এমনিতে মুশফিকের নিষ্কম্প মনকে! একটা সিঙ্গেল নিলেই যেখানে স্কোর সমান হয়ে যায়, আসলে শেষ হয়ে যায় ম্যাচও—তিনি কিনা উড়িয়ে মারতে গেলেন। ডিপ মিড উইকেটে ওই ক্যাচটা আসলে দুঃস্বপ্নের সূচনা, কেই-বা তা ভাবতে পেরেছিল! বাংলাদেশই তো জিতছে! স্ট্রাইকে চলে গেছেন মাহমুদউল্লাহ। ২ বলে ২ রান তো হচ্ছেই। মুশফিকের ভুল কি আর মাহমুদউল্লাহ করবেন!
ফুল টস পেয়ে মাহমুদউল্লাহর যুক্তি-বুদ্ধিও সব গুলিয়ে গেল। মুশফিকের মতো তাঁরও একই পরিণতি। শেষ বলে রান আউটে ম্যাচটা ‘টাই’ও হলো না। ৩ বলে ২ রান চাই, আর সেই তিন বলেই তিন উইকেট! না, টি-টোয়েন্টি এমন কিছু আর দেখেছে বলে মনে হয় না।
ওই তিনটি বল বাদ দিলে আগের দিনও বিপর্যস্ত মনে হওয়া বাংলাদেশ কী দারুণই না খেলল!
সব আশা যখন শেষ বলে মনে হয়, তখনই ঘুরে দাঁড়িয়ে চমকে দেওয়ার গল্প অনেকবারই লেখা হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। কালকের দিনটিকেও মনে হচ্ছিল তাতে নবতম সংযোজন। শুরু থেকেই যেন সেই চিত্রনাট্য অনুসরণ করে এগোচ্ছিল ম্যাচ।
বিশ্বকাপের বাইরে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি আর কয়টাই বা খেলা হয়! রেকর্ড দিয়ে তাই মাঠ বিচার করাটা কঠিন। তবে ভারতে এই সমস্যা নেই। আইপিএলের কারণে প্রতিটি মাঠেরই একটা চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে। সেই চরিত্র অনুযায়ী চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম ব্যাটিং-স্বর্গ। প্রথমে ব্যাটিং করে এই মাঠে গড় স্কোর ১৮৯। সেখানে ভারত করতে পারল ১৪৬। তার মানে বাংলাদেশই জিতছে!
আগের দিন মাশরাফি বিন মুর্তজা বলছিলেন, এই মাঠের ইতিহাস দেখেন, যে দল চেজ করে, তারাই সাধারণত জেতে। টানা সাত ম্যাচে টসে হারার পর অবশেষে মুদ্রা-ভাগ্য হাসল মাশরাফির দিকে চেয়ে। চোখ বুজে ফিল্ডিং। চেজ করবেন মাশরাফিরা। তার মানে বাংলাদেশই জিতছে!
একটা সমস্যা অবশ্য ছিল। এটা চিন্নাস্বামীর সেই চিরচেনা উইকেট নয়। এই বিশ্বকাপে ভারত এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যাচ্ছে, চেকড-ইন লাগেজের সঙ্গে যেন একটা টার্নিং উইকেটও দিয়ে দিচ্ছে! নাগপুর থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু—ভারত যেন এক উইকেটেই খেলছে। তা এমনই উইকেট, কোহলির মতো ব্যাটসম্যান ২২ বলে কোনো চার-ছয় মারতে পারেননি। শুভাগতকে একটা ছয় মারলেন, পরের বলেই আউট।
সেই উইকেটেই তামিমের ব্যাটে শুরু থেকেই স্ট্রোক প্লের ঝলক। দরকার ছিল ভালো একটা শুরুর। সেটি তো হলোই। ওই শেষ তিন বলের আগ পর্যন্ত সবকিছুই হলো।
মাশরাফি আগের ম্যাচে মাত্র এক ওভার বোলিং করেছিলেন বলে দলে তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। অধিনায়ক কাল পুরো ৪ ওভারই করলেন এবং তাতে রান মাত্র ২২। ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে তুলে আনার সিদ্ধান্তটা সম্ভবত কোচের। সকালে টিম মিটিংয়ে হাথুরুসিংহে নাকি এমনও বলেছিলেন, মাশরাফি তিনে নেমে গিয়ে ধুমধাম চালালে কেমন হয়! যা পাওয়া যাবে, তা-ই বোনাস। মাশরাফি অবশ্য একটা ছক্কার বেশি কিছু করতে পারলেন না। তা এই ‘বিন্দু বিন্দু জলকণা’ মিলেই না শেষে এসে এমন ‘সাগর’ প্রায় হয়েই যাচ্ছিল! সেই সাগর যে এমন শুকিয়ে যাবে, কেই-বা তা জানত!
ক্যাচ ফেলার পর সেই ব্যাটসম্যানের প্রতিটি রানই ফিল্ডারের বুকে এসে বিঁধে। আর সেই ফিল্ডার যদি বোলার হন এবং পরের ওভারটা করতে এসে চারটি চার খান, তাহলে কেমন লাগবে! উত্তরটা খুব ভালো দিতে পারবেন জসপ্রীত বুমরা। শর্ট ফাইন লেগে তামিমের এমন একটা ক্যাচ ফেললেন, যেটি ফেলা খুব কঠিন ছিল। কোথায় তামিমের কৃতজ্ঞতাভাজন হবেন, উল্টো তামিম একটা ঝড় বইয়ে দিলেন তাঁর ওপর।
ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে। এই ম্যাচের বাংলাদেশ তো সাহসী বাংলাদেশ। ভাগ্যও তাই হাত ধরে হাঁটল। তিন-তিনটি ক্যাচ ফেললেন ভারতীয় ফিল্ডাররা। ভাগ্য! সেই ভাগ্যই তো শেষে এসে এমন বৈরী হয়ে গেল! নইলে কি আর এই ম্যাচ বাংলাদেশ হারে!
দারুণ ফিল্ডিং, মাশরাফির বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব, ব্যাটিংয়ে শুরু থেকেই ইতিবাচকতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া—সবকিছু মিথ্যা হয়ে গিয়ে শুধু সত্যি হয়ে রইল একটা দুঃস্বপ্ন!
শেষ তিনটি বল!

ভারত: ২০ ওভারে ১৪৬/৭
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৪৫/৯
ফল: ভারত ১ রানে জয়ী