পদ হারাচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা

SHARE

5195দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন, এরপর দু’দফা সরকার পতনের আন্দোলনে নেমে পুরোদস্তুর ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফেরা, আন্দোলন চলাকালে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা, সেই সঙ্গে শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মামলা-মোকদ্দমায় বিপর্যস্ত বিএনপি গত কয়েকবছরে ঘুরে দাঁড়ানোরই সুযোগ পায়নি। উল্টোদিকে রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষের দুর্বল এমন অবস্থানে ঘর গুছিয়ে নিজেদের অবস্থান বেশ শক্তপোক্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমন বাস্তবতায় নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে নিজেদের ষষ্ঠ কাউন্সিলের দিকে এগোচ্ছে বিএনপি, আভাস রয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফের দলটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া।

এই কাউন্সিল ঘিরে দলে চলছে নানা সমীকরণ। দলীয় সূত্রে ইঙ্গিত রয়েছে, শীর্ষপদসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তনের পাশাপাশি এবারের কাউন্সিলে চমক দেখাবেন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তবে কী সেই চমক, তা এখনই পরিষ্কার নয়। এছাড়া কোনো কারণে খালেদা জিয়াকে যদি কারাগারে যেতে হয়, তখন দলে মূল ভূমিকা কে পালন করবেন সে বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আসছে ১৯ মার্চ কাউন্সিলের সম্ভাব্য তারিখ চিন্তা করে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বিএনপি। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) কাউন্সিল করার অনুমতিও চেয়েছে দলটি।

এবারের কাউন্সিলে বিএনপিশিবিরে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন আসার ইঙ্গিত এখনো রয়েছে তা হলো- এক নেতার একাধিক পদে থাকার বিধান বাতিল করা। এমনকি ভবিষ্যতে যারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী তাদেরও জেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ না নিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকে রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতাদের দিয়ে বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর একটি পরিকল্পনাও রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে আবার শক্তিশালী করে তুলতে বিএনপিপ্রধান বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় নেতাদের কথাও মাথায় রাখছেন। এছাড়া শোনা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, দল থেকে তাদের বাদ না গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র দেয়ার কথাও।

এরআগে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটি মাঠপর্যায়ের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর সুপারিশে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতির উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি।

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. (অব.) জেনারেল মাহবুবর রহমান বলেন, দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি কঠোরভাবে মেনে চললে বহু উদীয়মান নেতাকে বিভিন্ন পদে অন্তর্ভুক্ত করা সহজ হবে। এতে দল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে। তবে এটি নিয়ে দলের ভেতর আলোচনা চললেও এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

আসন্ন কাউন্সিলে আরো যে পরিবর্তন আসার ইঙ্গিত রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- চেয়ারপারসনের নয়, এবার উপদেষ্টা পরিষদ হবে বিএনপির।

এসব বিষয় মাথায় রেখে দলের গঠনতন্ত্রে আনা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সংশোধনী। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দলে সঠিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। পাশাপাশি নেতাকর্মীরাও সক্রিয় হতে আগ্রহ দেখাবেন বলে মনে করছে তৃণমূল পর্যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর দলের কাউন্সিল হতে যাচ্ছে। ফলে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়েছে। পদ পেতে প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’

গয়েশ্বর আরো বলেন, ‘বিগত দিনে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন তাদেরই নতুন কমিটিতে গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশেষ করে তরুণদের আমরা প্রাধান্য দিতে চাই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নেতৃত্ব বিকাশে এবার এক নেতারা এক পদ- এ বিধানটি গঠনতন্ত্রে রাখার পক্ষে দলের অধিকাংশ নেতা। চেয়ারপারসনেরও এতে মৌন সম্মতি রয়েছে বলে জানান তিনি।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবার নির্বাহী কমিটির এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান পদটিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কোনো কারণে চেয়ারপারসন কারাগারে গেলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলে মূল ভূমিকা পালন করার কথা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের। দলটির বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন দেশের বাইরে রয়েছেন; যিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা আসামি। সেক্ষেত্রে এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান পদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ওই পদে একজন বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন লোককে বসাতে চাচ্ছেন খালেদা জিয়া। এই পদের জন্য কেউ কেউ তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের নাম প্রস্তাব করলেও বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, যোগ্য এবং ত্যাগীদের পদ দেয়া হলে কে বাদ পড়ল তা নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ থাকবে না। নিষ্ক্রিয় ও অযোগ্যরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেলে নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়বে। দলের চেয়ারপারসনের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে, এবার অযোগ্য ও সুবিধাবাদী নেতারা সুবিধা করতে পারবেন না।

দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে একাধিক পদে যে নেতারা দায়িত্ব পালন করে আসছেন তাদের মধ্যে রয়েছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নাম। তিনি একইসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও কৃষক দলের সভাপতি। এছাড়া ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতিও তিনি। আসন্ন জাতীয় কাউন্সিলে মির্জা ফখরুল পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হতে যাচ্ছেন এমন সংবাদ শোনা গেলেও এটা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। দল পুনর্গঠনের চলমান প্রক্রিয়ায় কৃষক দলের সভাপতি ও ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির পদে তিনি আর থাকছেন না।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস দল ও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক পদে রয়েছেন। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা মহানগর বিএনপিরও অন্যতম সদস্য। দলের ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী পটুয়াখালী জেলা কমিটিরও সভাপতি। অপর ভাইস চেয়ারম্যান রাবেয়া চৌধুরী কুমিল্লা দক্ষিণ বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।

দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের মধ্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বন্দরনগরী চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি, আবদুল আউয়াল মিন্টু ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, শামসুজ্জামান দুদু চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি, আহমেদ আজম খান টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি, এমএ মান্নান ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি, শওকত মাহমুদ কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সভাপতি, অধ্যাপক মাজিদুল ইসলাম খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি।

যুগ্ম-মহাসচিবদের মধ্যে আমানউল্লাহ আমান ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য, মিজানুর রহমান মিনু রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি, মোহাম্মদ শাজাহান নোয়াখালী জেলা সভাপতি, বরকত উল্লাহ বুলু ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য, রুহুল কবির রিজভী দলের দপ্তর সম্পাদক।

ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে ফজলুল হক মিলন গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি, বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বরিশাল মহানগর সভাপতি, খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মসিউর রহমান ঝিনাইদহ জেলা সভাপতি, রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু লালমনিরহাট জেলা সভাপতি পদে রয়েছেন।

এছাড়া কেন্দ্রীয় সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকদেরও রয়েছে একাধিক পদ। একাধিক পদের দৌড়ে পিছিয়ে নেই নির্বাহী কমিটির সদস্যরাও।