ইউক্রেনের বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর পুতিনের হামলা কি ব্যর্থ হয়েছে?

SHARE

ইউক্রেনে বসন্তকাল মাত্র শুরু হয়েছে, মানুষ এখন ঋতু বদলের এই সময়টা উপভোগ করছে। রাতে এখনো বেশ ঠাণ্ডা। তবে এমন এক শীতকাল তারা পার হয়ে এসেছে, যখন রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মাঝে-মধ্যেই তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, ঘর গরম করার উপায় ছিল না, ছিল না গরম জলের সরবরাহ।
শীতকালটা তাদের দারুণ কষ্টে গেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলছেন, এই দুঃসময় কেটে গেছে। তার বার্তাটা ছিল এরকম: ইউক্রেনের যথেষ্ট শক্তি এখনো রয়েছে, তার দেশকে ধ্বংস করা যাবে না।
গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিন সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ কোথাও বন্ধ করতে হয়নি, এখন বরং চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি। গত তিন সপ্তাহে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নতুন কোনো হামলাও হয়নি। মনে হচ্ছে যেন ইউক্রেনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ধস নামানোর জন্য ভ্লাদিমির পুতিন যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তাতে তিনি ক্ষান্ত দিয়েছেন।
‘হ্যাঁ, এটা আমরা করছি, কিন্তু এটা কে আগে শুরু করেছে,’ গত ডিসেম্বরে কিয়েভকে দোষ দিয়ে বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
তখন অবশ্য ইউক্রনের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দেশটির প্রায় অর্ধেক জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত। ইউক্রেনের একজন পরমাণু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তখন এমন হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন যে, পরিস্থিতি রীতিমত সংকটজনক।
তবে হামলায় তিন সপ্তাহের বিরতির সময় রাশিয়া আসলে অস্ত্র মওজুদ করছিল। বৃহস্পতিবার ভোরবেলা তারা এক নাগাড়ে ৮১টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লো, আর এসব হামলায় চারটি অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হলো। শুক্রবার সকাল নাগাদ ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে পাঁচ লাখ মানুষের বাড়িতে কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না।
‘এখানে বেশ ঠাণ্ডা। আমাদের খাবার আছে, তবে এর অল্প কিছুই কেবল রান্না করা,’ বলছিলেন ওলেক্সি। তার মোবাইল ফোনের ব্যাটারির চার্জ আছে আর মাত্র ১৪ শতাংশ।
ওলেক্সির অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে থাকে পাঁচশো মানুষ। তিনি যখন তার মোবাইল ফোন চার্জ করার জন্য স্থানীয় ‘অদম্য কেন্দ্রে’ গেলেন, সেখানে আরও বহু মানুষ একই কারণে গিয়ে ভিড় করেছেন। অত মানুষের সেখানে জায়গা নেই।
কিয়েভেও তখন হামলা হয়েছিল। একটি হাসপাতালে ৭০০ মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু সেখানে কয়েক ঘণ্টা ধরে হিটিং চালানো যাচ্ছিল না বিদ্যুতের অভাবে। ছিল না গরম পানির সরবরাহ।
বেলারুসের সীমান্ত থেকে দক্ষিণে দুই ঘণ্টার গাড়ির পথে একটি শহর জিটুমির। সেখানেও দেড় লাখ মানুষের বাড়ির বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। শহরের মেয়র বললেন, পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ পরিস্থিতি থাকবে খুবই সংকটজনক। কিয়েভের পশ্চিমের এই শহরটিতে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে নিয়মিত ব্ল্যাক-আউট করতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
শহরের বাসিন্দা ইউজিন হেরাসিমচুক বসন্তের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের শেষে অফিসের কাজ গুছিয়ে আনছেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আশাবাদী।
‘কোনো ধরনের হামলা ছাড়া আমরা তিনটি সপ্তাহ পার করেছি এবং আমাদের বিদ্যুতও ছিল। আর বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল থাকায় শহরের কর্তৃপক্ষ আবার ট্রলি বাস এবং ট্রাম চালু করতে পেরেছে। এটা একটা বিরাট পদক্ষেপ। কারণ এর আগে শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা তো থমকে ছিল।’
ইউক্রেনের আরও বহু মানুষের বাড়ির বিদ্যুৎ সরবরাহ এরই মধ্যে আবার চালু হয়েছে, জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
‘এটা বলাই যায় যে, এনার্জি ফ্রন্টের যুদ্ধে ইউক্রেন জয়ী হয়েছে,’ বলছেন টেটিয়ানা বয়কো। তিনি একটি নাগরিক সংগঠন ওপোরার সঙ্গে কাজ করেন।
টেটিয়ানা জ্বালানি খাতের কর্মীদের এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রশংসা করলেন। ‘সবাই আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন। তবে আমার মনে হয় সবচেয়ে খারাপ অবস্থাটা আমরা পেরিয়ে এসেছি।’

শীত হয়তো শেষ হয়েছে, কিন্তু খারকিভের বাসিন্দা ওলেক্সির বিশ্বাস, ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে রক্ষার লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। অন্তত যতদিন রাশিয়ার এরকম হামলা চালানোর সক্ষমতা আছে।
ইউক্রেনের সব তাপ এবং জলবিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়ার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত অক্টোবরে রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর এই হামলা শুরু করেছিল। ইউক্রেনের জাপোরিশিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি ইউক্রেনের হাতছাড়া হয়ে গেছে, কারণ এই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ এখন রুশদের হাতে।
অনেক বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র এখন রুশ হামলায় ইস্পাতের দোমড়ানো-মোচড়ানো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে আর বাড়িতে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
ইউক্রেনে শীত যখন জাঁকিয়ে বসেছিল, তখন বিবিসি দুই সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনের কিছু প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানকে অনুসরণ করছিল। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে মেরামত করার চেষ্টা করছিলেন তারা।
এ রকম একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে ছয় বার ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলা হয়েছিল। এসব ট্রান্সফরমার নতুন করে বসাতে অনেক সময় লাগবে।
ইউক্রেনে হঠাৎ ট্রান্সফরমার হয়ে উঠল সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু।
তাদের যত ট্রান্সফরমার দরকার, গোটা বিশ্বে এক বছরে তত ট্রান্সফরমার তৈরি হয় না। এ পর্যন্ত মাত্র একটি হাই-ভোল্টেজ ট্রান্সফরমার ইউক্রেনে পাঠানো গেছে। তবে কম শক্তির কয়েক ডজন ট্রান্সফরমারও এসে পৌঁছেছে।
শীতকাল যখন শেষ হয়ে আসছিল, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী রুশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা মোকাবেলায় ততই দক্ষতা অর্জন করছিল।
তবে এই সপ্তাহে ইউক্রেনিয়ানরা কেবল ৩৪টি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পেরেছে। কারণ রাশিয়া এবার যেসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছিল সেগুলো ভিন্ন ধরনের, অনেক বেশি উচ্চ গতির। এর মধ্যে হাইপারসোনিক কেএইচ-৪৭ কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র হতে শুরু করে যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও আছে।
একজন সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ বলছেন, এসব ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা বিপুল।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার আগে পর্যন্ত চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৫টি পরমাণু চুল্লি ছিল, যেগুলো থেকে ইউক্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। এর মধ্যে ছয়টি ছিল জাপোরিশিয়ায়, যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যুদ্ধ শুরুর কিছুদিনের মধ্যে রাশিয়া দখল করে নেয়।
এই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে কয়েক মাস ধরে তীব্র বিতর্ক চলেছে। অভিযোগ উঠেছিল, রাশিয়া এটিকে তাদের বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়।
অন্য তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে ইউক্রেনের দক্ষিণে এবং পশ্চিমে। এই তিনটি কেন্দ্র থেকে আসে ইউক্রেনের প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ।
এটা শুনে মনে হতে পারে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। কিন্তু এবার শীত মৌসুমে অত ঠাণ্ডা পড়েনি, অন্যদিকে কঠোর পরিশ্রম করে ইউক্রেন নিজেকে খাদের কিনারা থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছে। ইউক্রেনিয়ানদের মধ্যে যে আশাবাদ এর ফলে সঞ্চারিত হয়েছে, সেটা বেশ টের পাওয়া যায়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংস্কার করে সচল করা গেছে। একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, রোদেলা দিন যত বাড়ছে, আবহাওয়া যত উষ্ণ হচ্ছে, রুশ বাহিনীর পক্ষে ইউক্রেনীয়দের ভয় দেখানো ততই কঠিন হয়ে পড়বে।

শীতকালে পূর্ব-মধ্যাঞ্চলীয় শহর দনিপ্রোর ওপর বেশ কিছু মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছিল। এ সপ্তাহেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ সরবরাহে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোন সমস্যা হয়নি।
‘এই শহর নিজেকে বদলে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। শহরের কেন্দ্রস্থলে হাঁটা-চলা করা এখন আর কোন ভীতিকর ব্যাপার নয়,’ বলছেন ইনা স্ট্যাংকো। কোলে তার দুই বছর বয়সী শিশু সন্তান।
ইনা ও তার পরিবার আবার গরম পানিতে গোসল করতে পারছেন, রান্না করতে পারছেন আগের মতো স্বাভাবিকভাবে। ‘আমরা এখন মানসিকভাবে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। কারণ আমরা এবং অন্য মায়েরাও এখন তাদের দিনটি কিভাবে কাটাবেন, সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারেন।’
খেরসনেও একই ধরনের কথা শোনা গেল। এই শহরটি যুদ্ধের শুরুতে রুশরা দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু গত নভেম্বরে তারা পিছু হটে দনিপ্রো নদীর অপর দিকে চলে যায়।
রাশিয়ার বাহিনী যখন এই শহর ছাড়ে, তখন কয়েক সপ্তাহ এখানে জীবন ছিল বেশ কঠিন। কারণ শহরে কোন জরুরি সেবা ব্যবস্থাই তখন চলছিল না।
‘এক মাস এক সপ্তাহ আমাদের কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। তারপর দিনে দুই ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ আসতো। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। এখন আর বিদ্যুৎ যাচ্ছে না,’ বলছিলেন স্থানীয় এক উদ্যোক্তা অ্যালেক্সি সানডাকভ।
অ্যালেক্সি বলছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ এখন নিয়মিত পাওয়া যায়। তবে এটাও সত্য শহরে বিদ্যুতের চাহিদা আগের চেয়ে কমে গেছে। কারণ রুশ হামলা শুরু হওয়ার আগে শহরের যে জনসংখ্যা ছিল তা এখন কয়েকগুণ কমে ৫৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
ইউক্রেনজুড়েই এভাবে জনসংখ্যা কমেছে, কারণ প্রায় ৮০ লাখ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এতে করে অবশ্য জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর চাহিদার চাপ অনেক কমে গেছে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমেছে, কারণ শরণার্থী হয়ে দেশ ছাড়া মানুষদের অনেকে এখনো ফিরে আসেনি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বশেষ হামলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা দ্রুতই মেরামত করা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা বেশ গুরুতর। তবে ইউক্রেনের প্রকৌশলীরা কয়েকদিনের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করার ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে, এমনকি বড় ধরনের হামলার পরও।
‘এটা একটা প্রতিযোগিতার মতো। ওরা কত দ্রুত আমাদের ক্ষতি করতে পারে এবং কত দ্রুত আমরা সেটা মেরামত করতে পারি। আর এই প্রতিযোগিতায় আমরাই জিতছি,’ বলছেন ওলেকসান্দার খারচেংকো, যিনি কিয়েভের এনার্জি ইন্ডাস্ট্রি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক।
জিটোমিরের বাসিন্দা ইউজিন হেরাসিমচুক বিশ্বাস করেন, পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে।
‘বহু ইউক্রেনিয়ানই বলে রাশিয়ার সঙ্গে একশো বছর থাকার চাইতে একটা ঠাণ্ডা এবং অন্ধকার শীতকাল অনেক উত্তম। কাজেই আমার মনে হয়, আমরা এটার মোকাবেলা করতে পারব’, বলছেন তিনি।
খারচেংকোর মতে, সবকিছু এখন ইউক্রেনিয়ানদের পক্ষে- আবহাওয়া ক্রমে ভালো হচ্ছে, আন্তর্জাতিক দাতা এবং জ্বালানি খাতের পেশাদার লোকজনের দিক থেকেও যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে তিনি বেশ সতর্ক।
‘আমি বলব না যে জ্বালানির যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি, তবে এটা আমরা বলতে পারি, অন্তত এই শীতের জ্বালানির লড়াইয়ে আমরা জিতেছি।’
খবর বিবিসি