তিন সিটি নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি

SHARE

bnp logoচলমান আন্দোলন অব্যাহত রেখেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি। ভোট পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামে শুধু অবরোধ রেখে হরতাল শিথিল করা হতে পারে। ইতিমধ্যে তিন সিটি করপোরেশনে সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ‘সবুজ সংকেত’ দিতে শুরু করেছে দলের হাইকমান্ড। আগামী দু’একদিনের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দলটি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া অথবা না নেওয়ার ‘সুফল’ সম্পর্কেও জোট ও দলের সিনিয়র নেতা, সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী এবং দল সমর্থিত পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ ও শুভাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নানা যুক্তি তুলে ধরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারাও। গতকাল রাতেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হলে বিএনপি সিটি নির্বাচনে যেতে পারে। সূত্র জানায়, বৈঠকে খালেদা জিয়া তিন সিটি নির্বাচনে ছাড় দেওয়া যাবে না জানিয়ে পেশাজীবীদের বলেন, এতে দল চাঙ্গা হবে। একই সঙ্গে তিনি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে সরকার নির্বাচনের তফসিল স্থগিত করতে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। পেশাজীবীরাও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে জোরালো মত দেন।

বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী পদে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, দক্ষিণে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, চট্টগ্রাম সিটিতে দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনকে সমর্থন দেওয়ারব্যাপারে প্রাথমিকভাবে চিন্তাভাবনা করছেন বিএনপি হাইকমান্ড। তবে কোনো কারণে এদের কাউকে সমর্থন দেওয়া সম্ভব না হলে ঢাকা উত্তরে যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ কাইয়ুম, দক্ষিণে দলের অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কারারুদ্ধ নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু এবং চট্টগ্রাম সিটিতে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও বর্তমান মেয়র এম মনজুর আলমের মধ্য থেকেও কেউ দলীয় সমর্থন পেতে পারেন। সূত্র জানায়, বিকল্প হিসেবে প্রতিটি সিটিতে মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিল পদে একাধিক দলীয় নেতাকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বলা হচ্ছে। ঋণখেলাপিসহ নানা কারণে প্রথম পছন্দের কারও মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেলে দ্বিতীয় বিকল্প প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া হবে।

অবশ্য দল ও জোটের ভেতর নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে দুটি মত রয়েছে। একটি বড় অংশ মনে করে, গুরুত্বপূর্ণ দুই সিটিতে যে কোনো কৌশলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। ইতিপূর্বে চারটি সিটিতেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া গত নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে অংশ নিলে একদিকে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা আবার সংগঠিত হওয়ার একটি সুযোগ পাবেন। আর পরাজিত হলে ‘ভোট কারচুুপির’ অভিযোগ তুলে আন্দোলন জোরদার করা যাবে। তবে ছোট একটি অংশ মনে করে, সরাসরি দল সমর্থিত প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে গেলে আন্দোলনের ক্ষতি হবে। সরকার প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে নেবে, বিএনপির তখন কিছুই করার থাকবে না। এ ছাড়া মামলা ও পুলিশের হয়রানির কারণে দল সমর্থিত প্রার্থীরা প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না বলে সংশয় ব্যক্ত করেন তারা।দলীয় সূত্র জানিয়েছে, মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। নির্বাচনে বিজয়ী হলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ‘যৌক্তিকতা’ প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করবে দলটি। ভোট কারচুুপি হলেও এ নিয়ে আন্দোলন জোরদার করার ইস্যু তৈরি হবে বলেও মনে করছে দলটির হাইকমান্ড। তবে আপাতত চলমান টানা অবরোধ ও হরতাল-কর্মসূচি সারাদেশে অব্যাহত রাখা হবে। সরকারকে চাপে রাখতে কর্মসূচি ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের বাইরে স্থগিত করা হবে না। প্রয়োজনে কর্মসূচিতে কিছু ভিন্নতাও আনা হতে পারে।

তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দলের মধ্যে দুই মত রয়েছে বলে জানিয়ে গতকাল শুক্রবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বিএনপি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, কী করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। শিগগির সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য টেলিফোনে দলের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, যারা জয়ী হতে পারবেন বলে বিবেচিত হবেন তারা দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার দিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বুধবার নবনির্বাচিত সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন শুভেচ্ছা জানাতে গেলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশ অনুসারে খন্দকার মাহবুব ও মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। তারা নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। তবে তিন সিটিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত হবে।

সূত্র জানায়, দুই আইনজীবী নেতার ইতিবাচক বক্তব্যের পরদিন বৃহস্পতিবার বিএনপি হাইকমান্ড দলের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে দলের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী আত্মগোপনে থাকা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর মতামত নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার সুফল সম্পর্কে তার মতামত এবং দল সমর্থিত প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুতি নেওয়ার ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হয়েছে।সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে সিটি নির্বাচনে বিএনপি সরাসরি প্রার্থী দিলে বেশি সুফল পাবে বলে মত দিয়েছেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। এ ক্ষেত্রে দল সমর্থিত প্রার্থী দেওয়ার পর তাকে মামলা ও গ্রেফতার এবং হয়রানি-নির্যাতন করলে বিষয়টি দেশি-বিদেশিরা ভালো চোখে দেখবেন না। এর সুফল বিএনপির আন্দোলনে কাজে লাগবে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণে দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছে দলের হাইকমান্ড। আগামী দু’একদিনের মধ্যে তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করবেন। অবশ্য আসাদুজ্জামান রিপনের সঙ্গে গতরাতে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এখনও দল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে কিছু বলা হয়নি। কাজেই এ মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়।এছাড়াও দক্ষিণে আবদুস সালাম ও নাসির উদ্দিন পিন্টুর পরিবারকেও প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। নেতারা জানিয়েছেন, মামলা বা আইনগত জটিলতার কারণে কারও প্রার্থিতা বাতিল হলে যাতে নির্বাচনে দলের প্রতিনিধিত্ব শূন্য হয়ে না পড়ে সে বিষয়টি মাথায় রেখেই একাধিক প্রার্থীকে প্রস্তুত রাখা হচ্ছে।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, টানা অবরোধ ও লাগাতার হরতাল ‘অকার্যকর’ হয়ে আসায় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বিএনপি। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে আন্দোলনের নতুন মেরুকরণের ইস্যু হিসেবে দেখছে দলটি। সব হিসাবেই গুরুত্বপূর্ণ এ তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ‘অজুহাতে’ শিথিল হয়ে আসা আন্দোলন থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পারবে।এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বর্তমান মেয়র এম মনজুর আলমকে এবার বিএনপি সমর্থন নাও দিতে পারে। বিএনপির সমর্থনে মেয়র হওয়ার পর থেকে চেয়ারপারসনের এ উপদেষ্টার কর্মকাণ্ডে দলের হাইকমান্ড নাখোশ বলে জানা গেছে।

সূত্র আরও জানায়, সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদকেও গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। মহানগরের নেতাকর্মীদের মূল ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত ওয়ার্ডগুলোতে নেতৃত্ব ধরে রাখতে দল সমর্থিত কাউন্সিলরের বিকল্প নেই বলে মনে করেন নেতারা। একাধিক নেতা জানিয়েছেন, মহানগরের তৃণমূলকে শক্তিশালী করতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে দলীয় নেতাদের নির্বাচিত করার তাগিদ রয়েছে ভেতর থেকে।