ডলারে কড়াকড়ির পর কেন কমে যাচ্ছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়

SHARE

বাংলাদেশে গত কয়েক মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আয় হয়েছে এবং আগের তুলনায় রপ্তানি থেকেও উপার্জন কমে গেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুই প্রধান খাতে উপার্জন কমার এই দুঃসংবাদ এমন এক সময়ে এলো, যখন দেশটি বেশ কিছুদিন ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বড় রকমের অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে।

বাংলাদেশে আমদানির পেছনে যতটা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়ে থাকে, রপ্তানি আয় থেকে তা সাধারণভাবে কখনোই পূরণ হয় না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থানের জন্য দেশটিকে অনেকটাই নির্ভর করতে হয় রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ওপরে। কিন্তু বেশ কয়েক মাস ধরেই এই খাতে কোন সুখবর নেই।

সবশেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন তিন হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি, যা দিয়ে মোটামুটি চারমাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। কিন্তু আমদানিনির্ভর বাংলাদেশে একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান দুটো উৎস রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের নেতিবাচক প্রবণতাকে কোন কোন অর্থনৈতিক বিশ্লেষককে বেশ চিন্তা ফেলেছে।

বিশ্লেষকরা বোঝার চেষ্টা করছেন যে কর্মকর্তারা যখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়াতে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তখন রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমার পেছনে কোন বিষয়গুলো ভূমিকা রেখেছে, কিংবা এই প্রবণতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কী বার্তা দিচ্ছে।

রেমিট্যান্স কমে যাওয়া কতটা উদ্বেগের?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে যে প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় এই আয় কমেছে অন্তত ১০ শতাংশ।

দুটি ঈদ বা উৎসবের মৌসুমে বাংলাদেশে সাধারণত সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে। ওই সময় ছাড়া দেশটিতে গড়ে ২০০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে।

কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এই খাতে আয় এতটা কমে যাওয়ার কারণ কি? গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন যে বেশ কিছুদিন ধরে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় এটা ঘটেছে।

তিনি বলেন, ‘আসলে রেমিট্যান্সের একটি নেতিবাচক প্রবণতা আমরা গত অর্থবছরেই দেখেছি। আগের বছরের তুলনায় গত বছর রেমিট্যান্স গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ফলে রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি।’

এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ে অস্থিরতা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জুড়েই অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপরে।

তবে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমতে থাকলেও গত মাসে ১০ শতাংশের বড় ধরণের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পেছনে আরও কারণ আছে বলে ধারণা করছেন সেলিম রায়হান। তার মতে, মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা রেমিট্যান্স কমার পেছনে একটা বড় কারণ হতে পারে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন যে খোলাবাজারের তুলনায় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সের বিপরীতে কম টাকা পাওয়া যাচ্ছে, আর এই কারণেই হয়তো দেশে প্রবাসীদের আয় আসলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্সের হিসোবে যোগ হচ্ছে না।

অর্থাৎ তার মতে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বিনিময় হার কম থাকার কারণে হয়তো বিদেশে বসবাসরত কর্মীরা দেশে অর্থ পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহার না করে হুন্ডি বা বিকল্প চ্যানেল ব্যবহার করছেন।

তার কথার প্রমাণ পাওয়া গেল সৌদি আরব প্রবাসী জনি মিয়ার (তার আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি) বক্তব্যে।

‘দেশে তো প্রতি মাসেই টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু ব্যাংকে পাঠানো হলে পরিবার টাকা কম পায়। এখানে কিছু দোকান আছে। ওদের কাছে টাকা দিলে দিনের মধ্যেই পরিবার টাকা পায়, আবার টাকাও বেশি (ব্যাংকের চেয়ে) পাওয়া যায়।’

প্রবাসী এই বাংলাদেশি কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা এতদিন ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বাংলাদেশে টাকা পাঠাতেন। কারণ, এক্ষেত্রে দুই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে ভালো বিনিময় মূল্য পাওয়া যেতো।

কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে ডলারের বিনিময় মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার পর হঠাৎ করে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পর প্রবাসীদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে গিয়ে দেশে টাকা পাঠাতে শুরু করেন।

গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সর্বশেষ ২রা অক্টোবর ডলার লেনদেন হয়েছে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা ২০ পয়সা হারে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে দেয়া হচ্ছে ১০৭ টাকা। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক বাজার বা কার্ব মার্কেটে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য বহুল ব্যবহৃত মার্কিন এই মুদ্রা বিক্রি হচ্ছে এর চেয়ে বেশি দামে।

অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান মনে করেন যে রেমিট্যান্স আয় এবং রপ্তানিখাতে উপার্জন নিয়ে উদ্বেগ এবং শঙ্কা বাড়তেই থাকবে যদি না এই দুটো ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।

‘আপনাদের হয়তো মনে আছে, এই অর্থবছরের শুরুর দিকে আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের চাপ পড়েছিল। সেটার একটা কারণ ছিল, রেমিট্যান্স আয় কমার ফলে আমাদের অর্থনীতিতে ফরেন কারেন্সির সরবরাহ কমে যাওয়া।’

ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘যেহেতু আমাদের অর্থনীতির দুটো বড় চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি খাত- তার যে গতিপ্রকৃতি, তাতে বলা যায় আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি বড় সংকট চলছে। সেই সঙ্কট উত্তরণে এই দুটির সহায়ক ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। ফলে অবশ্যই উদ্বেগের জায়গা আছে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ফরেন রিজার্ভে আমাদের স্বস্তির জায়ড়া আরও কমতে থাকবে।’

গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২০২২ সালে বাংলাদেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ২০৩ কোটি ডলার। গড়ে প্রতি মাসে এসেছে ১৭৫ কোটি ডলার। সেই তুলনায় সেপ্টেম্বরে এসেছে ১৫০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের মতে, রেমিট্যান্স আয় সেপ্টেম্বর মাসে তুলনামূলকভাবে কম হলেও সেটা নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ নেই।

‘গত মাসে রেমিট্যান্স কিছুটা কম হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে বিভিন্ন সময় এটা কম-বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসবেরে সময় রেমিট্যান্স আয় বেশি হয়। জুলাই-অগাস্ট মাসেই দুই বিলিয়ন করে রেমিট্যান্স এসেছে,’ বলেন তিনি।

তবে রেমিট্যান্স কম আসার প্রবণতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স যাতে বৃদ্ধি করা যায়, সে জন্য বাইরের দেশগুলোয় রাষ্ট্রদূতদের বলা হয়েছে। আমাদের ব্যাংক, মন্ত্রণালয়ের লোকজন ভিজিট করছে। তারা যাতে ন্যূনতম ফর্মালিটি করে টাকা পাঠাতে পারে, সেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’

করোনাভাইরাস মহামারির সময় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মসংস্থান কমে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেটি আবার বেড়েছে এবং এই প্রবণতা আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

সেলিম রায়হান বলেন, ‘শ্রমিকদের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ তৈরি হয়েছিল, আশার কথা হলো, সেখানে একটা গতি এসেছে। এখন অনেকে বাইরে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা যাতে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে দেশে টাকা পাঠান, সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’

রপ্তানি আয়ের ভাটা
রেমিট্যান্সের পাশাপাশি সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয়ও কমে গেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এই মাসে রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের মোট আয় হয়েছে ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের বছর একই সময়ে আয় হয়েছিল ৪১৬.৫ কোটি ডলার।

দেখা যাচ্ছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় রপ্তানি আয় ৬.২৫ শতাংশ কমে গেছে।

বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। এই সময়ে এই খাত থেকেই আয় হয়েছে ৩১৬ কোটি ডলার।

এরপরেই রয়েছে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি।

বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকের মূল বাজার পশ্চিমা দেশগুলোতে পণ্যের চাহিদা হঠাৎ করে কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ।

প্রথম কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে মূল্যস্ফিতি বেড়ে যাওয়ার ফলে ওই সব দেশে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে, ফলে ভোক্তাদের নতুন ফ্যাশনের প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে।

‘আমাদের ক্রেতারা প্রথমে যেভাবে গার্মেন্টস পণ্যের অর্ডার দিয়েছিলেন, তাদের বিক্রি সেভাবে হয়নি। ফলে তারা নতুন করে পণ্য নেয়ার ক্ষেত্রে ধীর গতি বেছে নিয়েছে। এটারই একটা প্রভাব পড়েছে আমাদের রপ্তানি আয়ের ওপর।’

অন্যদিকে, ইউরোপের দেশগুলোয় ডলারের বিপরীতে ইউরো ও পাউন্ডের বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ায় তাদের আমদানির খরচ বেড়েছে এবং এর ফলে ওইসব দেশেও আমদানি কমছে বলে জানান পারভেজ।

একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যতম বড় রিটেইলার ওয়ালমার্ট আগে যে ধরনের পোশাকের অর্ডার দিয়েছিল, পরে তারা বিক্রি মন্দা দেখে সেটা কমিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার বাজার থেকে এইচএন্ডএম বেরিয়ে আসায় সেখানে তাদের ৫০০ স্টোর বন্ধ হয়ে গেছে।

তৈরি পোশাক শিল্পের এই শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী আশঙ্কা করছেন যে অন্তত আগামী দুই মাস এই ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। তবে ডিসেম্বর মাসে ক্রিসমাসের কেনাকাটা শুরু হওয়ায় তখন অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে, ফলে রেমিট্যান্স বা রপ্তানি আয় সামান্য কমলেও আমদানির মূল্য পরিশোধে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।

তিনি বলেন, ‘ফলে এখনো আমাদের উদ্বেগের কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।’