নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতিতে ১৫ লাখের চুক্তি, অগ্রীম নিতো ২ লাখ

SHARE

দেশের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র সমাধান করে হলের ভেতর পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠাতো প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যরা। এজন্য ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করতো তারা। এর মধ্যে অগ্রীম দিতে হতো ২ লাখ টাকা।

বৃহস্পতিবার (১৯ মে) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‍্যাব সূত্রে জানা যায়, কানের ভেতর এক অংশ ও অটোমেটিক কল রিসিভ হওয়া সিম লাগানো অপর অংশটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে হলে প্রবেশ করানো হতো পরীক্ষার্থীদের।

পরীক্ষা শুরুর পর কোনোভাবে প্রশ্নের ছবি চলে আসতো প্রশ্নফাঁস চক্রের হাতে। তাৎক্ষণিকভাবে বাইরে মেধাবীদের একটি টিমের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সমাধান করে ওই ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর বলে দেওয়া হতো।

jagonews24

নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়ার নামে পরীক্ষার্থীর সঙ্গে ১০-১৫ লাখ টাকায় চুক্তি হতো তাদের। এজন্য পরীক্ষার আগেই অগ্রিম দিতে হতো অন্তত ২ লাখ টাকা। এরপর পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করা হতো হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট। যার মাধ্যমে বাইরে থেকে সরবরাহ করা হতো প্রশ্নপত্রের সমাধান।

সম্প্রতি চলমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা ঘিরে তৎপর হয়ে ওঠা এই চক্রের মূলহোতা ইকবাল হোসেনসহ (৪২) চারজনকে গ্রেফতার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব-২)।

বুধবার (১৮ মে) দিনগত রাতে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে বেশকিছু ডিভাইস ও বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়। গ্রেফতার বাকি তিনজন হলেন- রমিজ মৃধা (৩০), নজরুল ইসলাম (৫০) ও মোদাচ্ছের হোসেন (৬২)।

এদের মধ্যে ইকবাল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। গ্রেফতার নজরুল আগারগাঁও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর ও মোদাচ্ছের মুজিবনগর সমাজসেবা কার‍্যালয়ের সাবেক সমাজকর্মী। এছাড়া, রমিজ একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করার পর এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে ডিভাইসগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়, চক্রটি গত ২২ এপ্রিল প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষায় ১৬ জনকে এ ডিভাইস সরবরাহের মাধ্যমে উত্তর সরবরাহ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। আগামী ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষায় আরও ১২-১৪ জনকে ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর সরবরাহের চুক্তি হয়েছিলো। তবে এর আগেই চক্রের মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

এ নিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, চক্রের সদস্যরা প্রথমে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ওই নিয়োগ পরীক্ষার হল ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে।

‘এরপর তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাকরি প্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে ১০-১৫ লাখ টাকার চুক্তি করে। যারা এতে রাজি হতেন, অগ্রিম ২ লাখ টাকা নেওয়ার পর তাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো সরবরাহ করতো প্রতারক চক্র।’

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, চক্রের মূলহোতা ইকবাল হোসেন ২০০৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০১৫ সালে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি আলতাফ হোসেন নামে একজনের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে এই চক্রে জড়িয়ে যান তিনি। ২০২০ সালে করোনায় আলতাফ মারা যাওয়ার পর চক্রটি নিজেই পরিচালনা শুরু করেন ইকবাল।

গ্রেফতার রমিজ এই চক্রের অন্যতম সহযোগী। ২০২০ সালে ইকবালের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে এই চক্রে জড়ান তিনি। ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস সম্পর্কে তার ভালো অভিজ্ঞতা থাকায় পরীক্ষার সময় তিনিই পরীক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে সংযুক্ত করে বাইরে থেকে উত্তর সরবরাহ করতেন।

এক প্রশ্নের জবাবে মঈন বলেন, মোদাচ্ছের আর নজরুল মূলত পরীক্ষা কোন হলে অনুষ্ঠিত হবে, গার্ডের দায়িত্বে কে থাকবে, এসবের খোঁজ-খবর নিতো। এরপর পরীক্ষা শুরুর পর পর কারো মাধ্যমে প্রশ্নের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে তাদের কাছে চলে আসতো। আমরা সেসব লোকজনদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চক্রটি ২০১৫ সাল থেকে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে ১০-১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করতো। আনুমানিক ৩০ জনের সঙ্গে চুক্তি করলে ২-৩ জনকে কোনোভাবে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো তারা। অনেক সময় স্বাভাবিকভাবেই ৩-৪ জন চাকরি পেয়ে যেতো। এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

২০২০ সাল থেকে ডিভাইসের মাধ্যমে নতুন পন্থায় চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার এই প্রতারণা শুরু করে চক্রটি। অনেক সময় তারা পরীক্ষার্থীদের খোঁজ নেয়। আবার অনেক সময় যারা পরীক্ষায় অংশ নেয় তারাই তাদের কাছে যায়। গত ২২ এপ্রিল ১৬ জনকে এ প্রক্রিয়ায় উত্তর সরবরাহ করেছে বলে জানতে পেরেছি। আমরা তাদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছি।

এই ডিভাইসগুলো তারা কীভাবে কোথা থেকে এনেছে এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, এই ডিভাইসগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে তারা অসৎ উদ্দেশ্যে এনেছে বলে জানিয়েছে। সাধারণত এ ধরনের ডিভাইসগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করে। আমরাও এগুলো কিনতে চাইলে যথাযথ নিয়ম মেনে কিনে থাকি। এর বাইরে কেউ এসব ডিভাইস বিক্রি করছে কি না, সেখানে আমাদের নজরদারি অব্যাহত থাকবে।